Sunday, May 5, 2024
জীবনযাপন

মৃতদের উদ্দেশ্যে ‘RIP’, এ সম্পর্কে কি বলছে হিন্দুশাস্ত্র?

কলকাতা ট্রিবিউন ডেস্ক: বর্তমানকালে পাশ্চাত্য বা ইউরোপ-আমেরিকার অনেক কিছুই বাদ-বিচার না করেই অন্ধ অনুকরণ শুরু হয়েছে। যা অনেকটা অকারণ গড্ডালিকা প্রবাহে পরিণত হয়েছে। এই ভূখণ্ডের মানুষের অধিকাংশরই আহার-বিহার, চলন-বলন-কথন নিজেদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। জাতীয় জীবনে বাড়ছে বৈদেশিক সংস্কৃতির প্রভাব বা ছায়া। বিষয়টি সাধারণ জনজীবন ছাপিয়ে ধর্মক্ষেত্রেও প্রবেশ করেছে। এমন অনেক বিকৃত আচার, অনুষ্ঠান, কথন, দ্রব্যের ব্যবহার, শব্দ, সঙ্গিতাদি আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠছে দিনের পর দিন, যা এই ভূখণ্ডের শাশ্বত সংস্কৃতির ধারক বাহকদের জন্য মোটেই কাম্য নয়। এমনি অসংখ্য বিষয়ের মধ্যে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় বিষয় হল, “RIP”.

ইদানিং শিক্ষিত তরুণ তরুণীর মধ্যে দেখা যায় কেউ মৃত্যুবরণ করলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনা করে একটি ইংরেজি বাক্য বলা হয়। বাক্যটি হলো “Rest In Peace”. যার বাংলা অর্থ হলো “শান্তিতে বিশ্রাম করো”। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, “Rest In Peace” এ সম্পূর্ণ ইংরেজি বাক্যটি ব্যবহৃত না হয়ে, এর সংক্ষিপ্তরূপ ব্যবহৃত হয়। “Rest In Peace” বাক্যটির সংক্ষিপ্তরূপ হল ‘RIP’. মৃত্যুশোকে মৃত ব্যক্তির বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে ‘RIP’ শব্দটিই বেশি প্রচলিত বা বেশি ব্যবহৃত হয়

“Rest In Peace” বা এর সংক্ষিপ্তরূপ ‘RIP’ এর বাংলা অর্থ “শান্তিতে বিশ্রাম করো”। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তি যেন শান্তিতে বিশ্রাম করতে পারে। তার বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে শান্তি কামনা করা হয়। কিন্তু ‘RIP’ শব্দটি আব্রাহামিক ধর্মের অনুসারীদের জন্য প্রযোজ্য হলেও, ভারতবর্ষীয় সনাতন, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ধর্মালম্বীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ এ ভারতবর্ষের ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে “Judgment Day” বা হাসরের ময়দানে শেষ বিচার হবে এ জাতীয় কোন তত্ত্ব নেই। সনাতন ধর্ম এবং শিখ ধর্ম বিশ্বাস করে আত্মা অবিনশ্বর এবং জন্মজন্মান্তরের পথচলায় সে মুক্তিলাভ করে। বৌদ্ধ ধর্মানুসারে ‘বাণ’ বা তৃষ্ণা রহিত হয়ে জীব যে মুক্তি লাভ করে, তাকে বলা নির্বাণ। এ নির্বাণ পরম শান্তির।

ব্যক্তির দেহান্তে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় শ্রাদ্ধাদি শান্তিকর্মের সাথে সাথে শান্তির বিধান সনাতন শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে । তাই ব্যক্তির অন্ত সংবাদ প্রাপ্ত হলে আমরা তার আত্মার সদ্গতি কামণা করে ইউরোপীয় ইংরেজি ভাষায় Rest In Peace” বা এর সংক্ষিপ্তরূপ ‘RIP’ না বলে নিজ ভাষায় বলতে পারি, “ঈশ্বর তার বিদেহী আত্মাকে সদ্গতি প্রদান করুন”। এছাড়া আরও নিজ ভাষায় বলা যায়, “তার আত্মা শান্তিলাভ করুক”। দেশের জন্য, দশের জন্য বা জাতীর জন্য কেউ স্বেচ্ছায় নিজের জীবনের আত্মাহুতি দিলে বলতে পারি, “তার বিদেহী আত্মা বীরগতি প্রাপ্ত হয়ে অক্ষয় স্বর্গ লাভ করুক”। এছাড়া অন্তেষ্টিক্রিয়ায় ব্যবহৃত শ্লোকটিও বলতে পারি। সম্পূর্ণ শ্লোকটি না হলেও শ্লোকের শেষ পাদটি, অর্থাৎ “ওঁ দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু” অংশটি বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষ করে বাংলাদেশী হিন্দু সম্প্রদায় প্রায় সকলেই শ্লোকটির শেষ পাদটি ব্যবহার করে মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনা করে। শ্লোকটি মৃতদেহের উদ্দেশ্যে মুখাগ্নির মন্ত্র।এ মন্ত্রটি পাঠ করে চিতায় শায়িত শবকে বাম দিকে রেখে তিনবার বা সাতবার ঘুরে নিজে দক্ষিণমুখী হয়ে শবের শিরোদেশে বা মুখে অগ্নি প্রদান করতে হয়।

ওঁ কৃত্বা তু দুষ্করং কর্ম জানতা বাপ্যজানতা।

মৃত্যুকালবশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্বমাগতম্।

ধর্মাধর্মসমাযুক্তং লোভমোহসমাবৃতম্।

দহেয়ং সর্বগাত্রাণি দিব্যাল্লোঁকান্ স গচ্ছতু ॥

“জ্ঞানত বা অজ্ঞানত দুষ্কর কর্ম করে মৃত্যুকাল উপস্থিত হওয়ায় পঞ্চত্বপ্রাপ্ত, ধর্ম ও অধর্ম সমাযুক্ত, লোভ ও মোহের দ্বারা আচ্ছন্ন এই ব্যক্তির সর্বদেহ অগ্নিতে দাহ হয়ে ভস্মীভূত হোক এবং তার বিদেহী আত্মা দিব্যলোকে গমন করুক।”

আমাদের উচিৎ সনাতন শাস্ত্র বিরোধী এক সনাতন ধর্ম দর্শনের থেকে ভিন্নতর অর্থবাহী “Rest In Peace” বাক্যটির ব্যবহার বর্জন করা। মূলত এ বাক্যটি একমাত্র তাদের জন্যই প্রযোজ্য, যারা শবদেহকে মাটিতে কবরস্থ করে থাকে এবং যারা বিশ্বাস করে মৃতদেহের আত্মাটি কবরে “Judgment Day” বা শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে শায়িত থাকবে।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়