Friday, May 3, 2024
সম্পাদকীয়

সেঙ্গলের ইতিহাস

কলকাতা ট্রিবিউন ডেস্ক: রবিবার নতুন নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর আগে শনিবার মোদীর হাতে সেঙ্গল তুলে দেন মাদুরাই অধিনম মন্দিরের প্রধান মহন্ত অধিনম হরিহর দাস স্বামীগল। সেঙ্গল সংসদ ভবনের ভেতরে স্থায়ীভাবে থাকবে। অধ্যক্ষের চেয়ারের পাশে সেঙ্গল সাজিয়ে রাখা থাকবে। সেঙ্গলের ইতিহাসের সাথে তামিলনাড়ুর যেমন সংযোগ আছে, অনুরূপ ভাবে নেহেরুর সাথেও সংযোগ আছে।

সেঙ্গল কি? 

সেঙ্গল একটি তামিল শব্দ, যা সংস্কৃত শব্দ শঙ্খ থেকে এসেছে। শঙ্খের সাথে হিন্দু ধর্মের সম্পর্ক যেমন আছে, তদ্রূপ রাজনৈতিক ভাবেও সম্পর্ক আছে। শঙ্খকে অতি প্রাচীনকাল থেকেই ‘সার্বভৌমত্বের’ প্রতীক মানা হত। শঙ্খের মত দেখতে দণ্ডকে রাজদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করা হত। সাধারণত ‘রাজচক্রবর্তী’ গোত্রের নৃপতিই ‘সেঙ্গল’ রাজদণ্ড বহন করতেন রাজকার্যের সময়ে। সেঙ্গল সাধারণত আপাদমস্তক স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য দিয়ে গড়া হত। শঙ্খের জায়গায় অনেক সময়ে মূল্যবান পাথর লাগানো হত সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। সেঙ্গল অনেক সময়ে ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রতীক হিসাবেও ব্যবহৃত হত — রাজা উত্তরাধিকারীর হাতে রাজদণ্ড দিয়ে বানপ্রস্থে যেতেন। অমিত শাহ জানিয়েছেন উক্ত সেঙ্গলের মাথায় মহাদেবের বাহন নন্দীর একটি ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি থাকবে। এই ধরণের নন্দী সংবলিত রাজদণ্ড বা সেঙ্গল চোল রাজারা ব্যবহার করতেন।

নেহেরু ও সেঙ্গল 

সেঙ্গলের ইতিহাস কিন্তু অতি প্রাচীন, বস্তুত ভারতের স্বাধীনতার সাথে এর সম্পর্ক আছে। অনেকেই জানেন না, ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালের মাঝরাতে যখন ব্রিটিশরা ক্ষমতার হস্তান্তর করছিল, তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেন নেহেরুর হাতে একটি সেঙ্গল তুলে দিয়েছিলেন। যখন মাউন্টব্যাটেন তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ক্ষমতার হস্তান্তর অনুষ্ঠান কিভাবে আয়োজন করা উচিত? তখন নেহেরু তার সহযোগীদের কাছে একি প্রশ্ন রাখেন উত্তর পাওয়ার জন্য। ঐ সময়ে চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী তাকে সেঙ্গলের কথা বলেন। সঙ্গে সঙ্গে নেহেরু তাকে সেঙ্গল আনতে আদেশ দেন। বিমানে করে মাদ্রাজ গিয়ে রাজাগোপালাচারী ভূমিড়ি বঙ্গারু জুয়েলার্স থেকে নির্মিত সেঙ্গল নিয়ে আসেন, এরপর মাঝরাতে মাউন্টব্যাটেন যথারীতি চোল রীতিনীতি মেনেই সেঙ্গল নেহেরুর হাতে তুলে দেন।

চোল ইতিহাসের প্রতীক সেঙ্গল 

মাউন্টব্যাটেন নেহেরুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক হিসাবে সেঙ্গল দিচ্ছিল, সে সময়ে কয়েকজন কাঞ্চী থেকে আসা পুরোহিতও ছিলেন। তারাই অনুষ্ঠান পালন করেছিলেন। এরপর সেঙ্গলের কি হল, আর জানা যায় না। সবাই এর কথা ভুলে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালে একজন তামিল ইতিহাসবিদ এ নিয়ে প্রশ্ন করে ভারত সরকারের কাছে উত্তর পান নি। তিনি ২০২১ সালে আবার একই প্রশ্ন রাখেন আরটিআই মারফত। বিজেপি খুঁজে বের করার চেষ্টা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। খুঁজে পাওয়ার পর সেই ইতিহাসবিদকে ডেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ৯৬ বছর বয়স্ক ঐ ইতিহাসবিদ ১৯৪৭ সালেও পার্লামেন্টে ছিলেন। ২৮ মে’র দিনেও ছিলেন।

সেঙ্গলের ইতিহাস 

রাজদণ্ড বা সেঙ্গলের ইতিহাস বহু প্রাচীন। ২৯৫ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসন ত্যাগ করার সময়ে তার পুত্র হাতে সেঙ্গল তুলে দেন রাজদণ্ডের প্রতীক রূপে। সেই থেকে পালাক্রমে শুঙ্গ, কণ্ব, গুপ্ত রাজবংশের সময়েও যখন রাজা ক্ষমতা হস্তান্তর করতেন, তখন সেঙ্গল ব্যবহার করতেন। পরে পল্লব, চোল ও বিজয়নগর সাম্রাজ্যও একই পদ্ধতি অনুসরণ করত ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে।

মুঘল আমলে শেষবার সেঙ্গল ব্যবহৃত হয় ১৭৬৫ সালে। এরপর তাদেরই সেঙ্গল নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের ওপর তাদের কর্তৃত্বের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করত। ১৮৫৭ মহাবিদ্রোহের পর সেঙ্গল ব্যবহারের রীতি একেবারেই উঠে যায়। সেঙ্গল শেষ ব্যবহৃত হয়েছে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে।

কিভাবে সেঙ্গলের কথা জানা গেল? 

প্রয়াগরাজ শিল্প যাদুঘরে বহুকাল ধরে সংরক্ষিত ছিল নেহেরু-মাউন্টব্যাটেন রাজদণ্ড। যা এতকাল নেহেরুর স্বর্ণষষ্টি হিসাবেই খ্যাত ছিল। কয়েকদিন পূর্বে একটি চেন্নাই স্থিত স্বর্ণকার প্রয়াগরাজ যাদুঘরে এসে ঐ স্বর্ণষষ্টি দেখে বিস্মিত হয় এবং দাবি করে, এটা কোনও সাধারণ ষষ্টি নয় — ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক একটি রাজদণ্ড। ভূমিড়ি বঙ্গারু জুয়েলার্স সংস্থার কর্ণধার ঐ স্বর্ণকার দাবি করেন এটাই সেই সেঙ্গল, যা তারা নেহেরুর জন্য তৈরী করে দিয়েছিলেন।

লিখেছেন: Ayan Chakrabarty