Thursday, May 16, 2024
সম্পাদকীয়

‘অপারেশন মেশিন’ ডাঃ দেবী শেঠি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ওপেনহার্ট সার্জারীর খরচ ৬০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা। মেক্সিকোতে খরচ প্রায় ২৪ লাখের মতো। অথচ ভারতের নারায়ণা হেলথ হাসপাতালে সেই খরচ মাত্র ৯০ হাজার টাকা। ভাবছেন এত কম খরচে কিভাবে সম্ভব এত ব্যয়বহুল সার্জারী? এ বিষয়ে জানতে হলে কিছুটা পিছনে জানতে হবে।

৩ ডিসেম্বর ১৯৬৭ সাল দক্ষিণ আফ্রিকান ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান বার্নাড সফলভাবে সম্পন্ন করলেন বিশ্বের প্রথম হার্ড ট্রান্সফার। ঘটনাটি ভীষণভাবে অনুপ্রেরণা দেয় কর্ণাটকের ক্লাস ফাইভে পড়া ছোট্ট একটি শিশুকে। শিশুটির নাম দেবী শেঠি (Devi Shetty)। দশ বছরের দেবী শেঠি সেদিনই ঠিক করে ফেলেন বড় হয়ে সে হার্ট সার্জন হবে। শিশুটি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছিল। তবে শুধু লক্ষ্যে পৌঁছেই থেমে থাকেননি তিনি। ওপেন হার্ট সার্জারীর জগতে আমূল পরিবর্তন নিয়েও এসেছেন।

২০০১ সালে তাঁর হাত ধরে বেঙ্গালুরুতে নারায়ণা হেলথ হাসপাতালের। ভারতে একটি সময়ে প্রায় ২৩ লাখ সার্জারীর রুগী টাকার অভাবে সার্জারী করাতে পারতেন না। দেবী শেঠি এই করুণ অবস্থা দূর করেছেন। বর্তমানে ভারতের ৩১ টি নারায়ণা হেলথ হাসপাতাল থেকে সেবা পাচ্ছেন বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ।

দেবী শেঠি কর্ণাটকের দক্ষিণ কনাডা জেলার কিন্নিগলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে অষ্টম তিনি। ডাঃ দেবী শেঠি তাঁর মা-বাবার বরাবরের অসুস্থতার কারণে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ডায়বেটিক রোগী। ডায়াবেটিকস বাড়ার কারণে তাঁর বাবাকে তিনি অনেকবার অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখেছেন। তাই তাঁর পরিবারের কাছে তখন ডাক্তারের চেহারাটাই ছিল যেন এক ঈশ্বরের মূর্তি। ছোটবেলায় মা-বাবার অসুস্থতা ঘটনা তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল।

১৯৯১ সালে নয় দিন বয়সি শিশু রনির হৃত্‍পিণ্ড অপারেশন করেন তিনি। যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম সফল শিশু হৃত্‍পিণ্ড অস্ত্রোপচার। তিনি কলকাতায় মাদার তেরেসার ব্যক্তিগত চিকিত্‍সক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ডাঃ দেবী প্রসাদ শেঠী পৃথিবীর সেরা ১০ জন ডাক্তারের মধ্যে একজন। ভারতের এক নম্বর। এর পিছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো দেবী শেঠি রোগীকে সর্বোচ্চ চিকিত্‍সা সেবা দেবার সাথে সাথে তার অর্থনৈতিক অবস্থা অর্থাত্‍ ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে চান এবং সে মতে পদক্ষেপ নেন। নিশ্চয়ই অন্য কোনও ডাক্তার কারও অর্থনৈতিক অবস্থা জানতে চান না।

ডাঃ দেবী শেঠী একদিন একটি শিশুর জটিল ওপেনহার্ট সার্জারী করছেন। এমন সময় তাঁর বিশেষ সহকারী অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করে বলেন- স্যার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফোন করে লাইনে আছেন এবং আপনার সাথে জরুরি একটা আলাপ আছে বলেছেন। ডাঃ শেঠী দেখলেন এই শিশুটির অস্ত্রোপচার এ দেরী হলে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা তাই তিনি নিজের সহকারীকে বললেন,  প্রধানমন্ত্রীকে বলো আমি ওটিতে আছি এক ঘন্টা পর ফোন করার জন্য। অবশ্যই এক ঘন্টা পর প্রধানমন্ত্রী ফের ফোন করেন।

দেবী শেঠী ১৯৮২ কস্তুরবা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারীতে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। পরে ইংল্যান্ড থেকে সার্জারী বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেন। ১৯৮৯ সালে লন্ডনের উচ্চাভিলাষী চাকরীর লোভ ত্যাগ করে দেশে ফিরে আসেন। এখানে ডাঃ রায়ের সাথে তিনি কলকাতার গড়ে তোলেন ভারতের প্রথম হৃদরোগ চিকিত্‍সা হাসপাতাল বি এম বিড়লা হার্ট রিসার্চ সেন্টার। কিন্তু ভারতীয়দের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ইউরোপিয়ানদের তুলনায় তিনগুন বেশী হওয়ায় এই একটি হাসপাতাল যথেষ্ট ছিল না। এজন্য ডাঃ দেবী শেঠী ও ডাঃ রায় মিলে আরও তিনটি হৃদরোগ চিকিত্‍সা কেন্দ্র গড়ে তোলেন, বি এম বিড়লা হার্ট সেন্টার যাত্রা শুরুর অল্প দিনের মধ্যে ভারতের শ্রেষ্ঠ হার্ট হাসপাতালের একটিতে পরিণত হয।

ডাঃ দেবী শেঠীকে তাঁর বন্ধুরা বলতেন `অপারেটিং মেশিন`। দরিদ্র পরিবার থেকে আসা সবাইকেই তিনি বিনা মূল্যে চিকিত্‍সা করেছেন। উল্লেখ্য, ডাঃ দেবী শেঠি এবং তাঁর নারায়ণা হৃদয়ালয় দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে ওপেন হার্ট সার্জারীর মত ব্যয়বহুল চিকিত্‍সা দেয়। অন্যদিকে, এই হাসপাতাল লক্ষ্য রাখে যে কোন বয়সের হৃদরোগী যেন অর্থাভাবে চিকিত্‍সা সেবা বঞ্চিত না হয়। তাঁর হাসপাতাল থেকে সেবা পাচ্ছে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ। আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীটা দেবী শেঠির মতো মানুষদের পদচারণায় হয়ে উঠুক আরও সুন্দর।