Saturday, April 27, 2024
জীবনযাপন

সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই নিঃসঙ্গ

সৃষ্টিশীলতা মানুষকে নিঃসঙ্গ করে। সংস্কারমূলক সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। কেউ যখন অন্যদের থেকে আলাদা একটু চিন্তা করে, তখন অনেক মানুষ তাকে ঠিকমত সম্পূর্ণ বুঝতে পারে না। আলো ছায়ার মত, কখনো পারে, কখনো বা পারে না। তাকে ভুল বুঝে নিন্দা করে, পরে আবার অনুতপ্তও হয়। কিন্তু কিছু ভুলের অনুতপ্ততা মানুষকে সারা জীবন বইতে হয়।কারো যদি নিজস্ব স্বাধীন যৌক্তিক চিন্তাকাঠামো বা নিজস্ব মতামত থাকে। সে মতের যদি একটি স্বতন্ত্রতা থাকে,তবে তার প্রতি মানুষ যেমন আকর্ষিত হবে, প্রেরণা পাবে, ভালবাসবে ; তেমনি যুগপৎ একশ্রেণির মানুষ ঈর্ষান্বিত হয়ে নিন্দা করতে, অসম্মান করতে পেছনে লেগে যাবে। ধান থেকে যত বেশী চাল বের হবে, তত বেশী ধানের তুষ হবে, এটাই স্বাভাবিক। একইভাবে যত বেশী মানুষ ভালবাসবে, তত বেশী মানুষ ঈর্ষা করবে, ঘৃণা করবে, বদনাম করবে। তাই হয়ত চর্যাপদের কবি ভুসুকুপা লিখেছেন:

আপনা মাংসে হরিণা বৈরী 

“নিরপরাধ হরিণ তার নিজের সৌন্দর্য এবং সুস্বাদু মাংসের জন্যে নিজেই নিজের শত্রু।”

চিন্তার স্বতন্ত্রতা একটি অনন্য প্রাকৃতিক দান।আপনার মধ্যে এ স্বতন্ত্রতা থাকলে আপনার লজ্জা, ভয়, দমে যেমন যেতে নেই; তেমনিভাবে আত্ম অহংকারও করতে নেই। বুদ্ধির তালাটা জগতের সকল মানুষের খোলে না। যাদের খোলে তারাই নিন্দিত হয়, আলোচিত হয়, সমালোচিত হয়, প্রশংসিত হয়, পুরষ্কৃত হয় এবং দৃষ্টান্ত হয়। এ সত্ত্বার উদ্ভাস যদি আপনার মধ্যে ঘটে তবে, আপনি শত চাইলেও কোনদিন অন্যদের মত গড়ে “হরিবোল” টাইপের হতে পারবেন না বা আদৌ হওয়া সম্ভবও না। তাই আপনি নিজের অন্তঃস্থিত আপন সত্তার প্রকাশ ঘটান। ধীরেধীরে মানুষ বুঝতে পারবে আপনাকে। “প্রিয়ংবদা” অর্থাৎ যে সর্বদা প্রিয় বাক্য বলে, এটা সাহিত্যেই সম্ভব ; বাস্তবে সবসময় সম্ভব নয়।রবীন্দ্রনাথের মত প্রমিত ভাষা সর্বদা মানুষ বোঝে না। যারা যেমন তাদেরকে তাদের ভাষায়, তাদের মনোজগতের ভাষায়, তাদের মতই ব্যবহার করে বোঝাতে হয়। তেমন করে না বোঝালে তারা কোনদিনই তাদের ভুলগুলো উপলব্ধি করতে পারে না। বিষয়টি মহাভারতের উদ্যোগ পর্বেও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। 

যস্মিন্ যথা বর্ত্ততে যো মনুষ্য-

স্তস্মিংস্তথা বর্ত্তিতব্যং স ধর্মঃ। 

মায়াচারো মায়য়া বর্ত্তিতব্যঃ 

সাধ্বাচারঃ সাধুনা প্রত্যুপেয়ঃ।। 

(মহাভারত:উদ্যোগপর্ব, ৩৭.৭)

“যে মানুষ অন্যান্য মানুষের সঙ্গে যেমনভাবে চলে, সেই মানুষের সাথে ঠিক তেমনভাবেই চলা উচিত, এটাই ধর্মের নিয়ম। সাধুর সাথে সাধুতাই যেমন একমাত্র অবলম্বন; পক্ষান্তরে তেমনি মায়ার আশ্রয় নেয়া কপট ব্যক্তির সাথে কপট ব্যবহার করাই একান্ত কর্তব্য।”

আপনার কথা যদি প্রত্যেকেরই প্রিয় হয় তাহলে বুঝতে হবে, আপনি “ঝোলের লাউ অম্বলের কদু” হয়ে যাচ্ছেন। আপনার চিন্তার কোন স্বতন্ত্রতা নেই। নিন্দা মানুষ করবেই, যদি আপনার চিন্তাতে স্বতন্ত্রতা থাকে। মানুষ রেইনট্রি গাছে ঢিল মারে না, কারণ এর সুস্বাদু ফল নেই। ঢিল মারে আমগাছে, লিচুগাছে, যাদের রসাল সুস্বাদু ফল আছে। মানুষ নিন্দা করলেই বুঝতে হবে সমাজে আপনার একটা প্রভাব তৈরি হচ্ছে। আপনার ভাব কিছুটা হলেও প্রচার পাচ্ছে। কিছুক্ষেত্রে নিন্দা বা গঠনমূলক সমালোচনা মানুষের চিন্তাধারাকে রিভিউ করতে সাহায্য করে।

যারা অহেতুক অযৌক্তিক নিন্দা করে, ভেবে নিবেন তারা আপনার পর্যায়ভুক্ত নয়। আপনার অনেক নিচে। আপনাকে নিচে নামিয়ে তাদের পর্যায়ে আনতেই তাদের এ ঈর্ষান্বিত প্রয়াস। আপনার লক্ষ্য থাকবে, এগিয়ে যাওয়া। সামনের এগিয়ে থাকা মানুষটির সমপর্যায়ভুক্ত হওয়া। তাদের সংখ্যা অল্প, স্থান বেশী। তাই একবার সে স্থানে পৌঁছতে পারলে, পরে যাওয়ার আর ভয় নেই।

জগতে কিছু মানুষ থাকে বৃত্তেবদ্ধ। তাদের জীবন বৃত্ততেই ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু বৃত্তের বলয় থেকে বের হয়ে যারা নিজের মতের স্বতন্ত্রতা স্থাপন করতে পারে, জগত তাদেরই মনে রাখে। জগত কোন সর্বদা “হ্যাঁ হুজুর” বলা তোষামোদকারীদের মনে রাখে না। আপনাকেই ঠিক করতে হবে আপনি হুজুরের মজুর হবেন, নাকি মজদুরদের হুজুর হবেন। হুজুরের মজুর হলে সাময়িক হয়ত কিছু কলা-মুলার সুবিধা পাবেন, কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে না। বিপরীতে আপনি গরীব হোন বা যাই হোন, যদি মজদুরদের হুজুর বা সাধারণ মানুষের মধ্যে অসাধারণ হতে পারেন; তবে আপনার অন্ততপক্ষে মত প্রকাশের স্বাধীনতাটা থাকবে। আপনাকে আর গড্ডালিকা প্রবাহে অন্যের পিছে পিছে অন্ধের মত চলতে হবে না। আপনার চিন্তার স্বতন্ত্র চুনিপান্না আপনাকে গন্তব্যে নিয়ে যাবে। এর জন্যে দৃষ্টিভঙ্গি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আপনি যা ভাববেন, যা চিন্তা করবেন আশেপাশে তাই দেখবেন। দেখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ দেখা থেকেই জগতের সকল দর্শনের উৎপত্তি। এ দার্শনিক ভাবটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আমি’ কবিতায় অত্যন্ত নান্দনিকভাবে বলেছেন:

“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,

 চুনি উঠল রাঙা হয়ে।

 আমি চোখ মেললুম আকাশে, 

জ্বলে উঠল আলো

পুবে পশ্চিমে।

গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, সুন্দর,

সুন্দর হল সে।”

বোবা বা মৃতদেহের কোন শত্রু থাকে না। আপনার পিছনে যখন কিছু মানুষ অকারণে লেগে যাবে, তবে বুঝবেন আপনি বোবা বা মৃতের একটিও নন। আপনি একজন সচল জীবন্ত মানব। প্রদীপের আলো বাতাসে নিভে যায়, সাহস স্বাভিমানের আলোকে বাতাস স্পর্শও করতে পারে না, সে অনির্বাণ শিখা হয়ে জ্বলতে থাকে।

বিরোধিতাকারীরা সাধারণত দুইপ্রকারের হয়।প্রথম প্রকার হল, বুঝেশুনে গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক বিরোধিতা। এবং অন্যটি হল না বুঝে বিরোধিতা করা। প্রথম প্রকার বিরোধিতা থেকে অনেক কিছুই শেখা যায়, নিজেকে সুধরে নেয়া যায়, যা জীবন চলতে কাজে লাগে। বিপরীতে না বুঝে বিরোধিতা অত্যন্ত ভয়াবহ। কিছু মানুষ আছে যারা সুক্ষ্ম কোন বিষয়ে বোঝার এবং ভাবার ক্ষমতা নেই। তারা সবকিছুই মোটাদাগে বোঝে। এরা কোন বিষয়েই “টু দি পয়েন্টে” বোঝে না ; সকল বিষয়েই তারা তাদের মত করে একটা একটা একপেশে সাইড মিনিং তৈরি করে ফেলে। এবং তার আলোকেই সকলের সাথে তর্কে জড়ায় এবং অন্যকে তর্কে প্ররোচিত করে। অথচ আমাদের শাস্ত্রে চিন্তা বা দর্শনের ক্ষেত্রে এমন একপেশে বিষয়গুলো নিষিদ্ধ। বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতি আগম শাস্ত্রে বলা হয়েছে:

যুক্তিহীনবিচারে তু ধর্মহানিঃ প্রজায়তে।

“যুক্তিহীন বিচার ধর্মের হানি ঘটায়”

আলোচনা বিশেষ করে, শাস্ত্র আলোচনা হবে শাস্ত্রাদি প্রমাণ দিয়ে, সেখানে তারা অনর্থক যুক্তিবিহীন ব্যক্তিগত আক্রমণ করে থাকে। তাদের মত করে সবাইকে জোরজবরদস্তি করে হলেও তাদের মতামত অন্যকে বোঝাতে চায়।এদের হাবভাবে দেখলে সুকুমার রায়ের “বুঝিয়ে বলা” কবিতার সেই বুড়ো দাদুর কথা মনে পড়ে; যিনি জোর করে হলেও বোঝাবেন আর কেউ না বুঝলে তার মাথায় গজাল মেরে গোঁজাবেন।

“আজকে তোকে সেই কথাটা বোঝাবই বোঝাব—

না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল মেরে গোঁজাব।”

আমাদের শাস্ত্রে তিনপ্রকার তর্কের কথা বলা হয়েছে: বাদ, জল্প, এবং বিতণ্ডা। বাদ হল দুজনের আলোচনাতে একটা সিদ্ধান্তে পৌছানো। জল্প হল অন্যের কথা না শুনে, যার যার কথা সে সে বলে যাওয়া এবং বিতণ্ডা হল নিজের বলার কিছুই নেই অন্যের নিন্দা বা যুক্তিখণ্ডন। এরমধ্যে শ্রেষ্ঠ হল বাদ সিদ্ধান্তবাদ। শাস্ত্র নির্ণয়ের এ সিদ্ধান্তবাদ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে (১০.৩২) বলা আছে:

অধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাং বাদঃ প্রবদতামহম্” 

” বিদ্যার মধ্যে অধ্যাত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা এবং পরস্পর তর্ককারীদের মধ্যে আমি সত্য নির্ণায়ক বিচারস্বরূপ বাদ।”

জগতের ইউনিক ব্যবস্থাপনা হল মানুষকে ব্যবস্থাপনা। লাখ লাখ বই এবং লাখ লাখ তত্ত্ব তৈরি হলেও মানুষকে সম্পূর্ণভাবে ব্যবস্থাপনা অসাধ্য। এটা হল একঝাঁক ব্যাঙকে একটি পালায় মাপার মত।হাজার প্রয়াসেও কাজটি সমাপ্ত হয় না। কোন বিষয়ে না বুঝে বিরোধিতাকারীদের মধ্যে একটা শ্রেণী আছে সুযোগ সন্ধানী প্রবঞ্চক, এদের সহজ ভাষায় জ্ঞানপাপীও বলা যায়। এরা নিজেরা হয়ত সত্যটা জানে, কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থে মিথ্যা বলে। কখনও কখন কোন নিরপরাধ মানুষের নামে মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা কুৎসা ছড়ায়। এরা একপ্রকার অপরাধী, এদের মধ্যে কেউ আছে যাদের অপরাধী মানসিকতা রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। অপরাধ করা এবং অপরাধে প্ররোচনা দেয়া ছাড়া এরা থাকতে পারে না। এরাই মানুষকে সাময়িক ভুল বুঝিয়ে অপরাধ করতে প্ররোচিত করে। 

এ স্বার্থান্বেষী অপরাধীরা স্বার্থে ঘা লাগলে আপনার পিছনে নিজে অথবা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে লেগে যাবে। কিন্তু আপনার তাতে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছুই নেই। জগতের ইতিহাস পাঠকমাত্রই জানেন, সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই নিঃসঙ্গ। বৃত্তেবদ্ধ জীবন, বৃত্তেবদ্ধ চিন্তা, বৃত্তেবদ্ধ সংস্কার বৃত্তেই আবর্তিত হয়, মুক্তি মেলে না।সঙ্কটে বিহ্বলিত হওয়ার কিছুই নেই, আজ হয়ত আপনি একা, কিন্তু আপনার চিন্তাশীলতায় যদি শক্তি সঞ্চিত থাকে তবে, আগামীতে লাখোলাখো মানুষ এর দ্বারা প্রভাবিত হবে। একটু সংস্কারমূলক ভিন্নধর্মী চিন্তা যাঁরা করেছে ইউরোপের সক্রেটিস সহ ভারতবর্ষের রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ এঁদের কারো জীবনের পথই স্বচ্ছ কুসুমাস্তীর্ণ হয়নি। সক্রেটিসকে তো বিচারের প্রহসনের নামে হেমলক পান করিয়েই মেরেই ফেলা হল। আপনার চিন্তার স্বতন্ত্রতা আছে, এর মানে মানুষ আপনাকে আজ যেমন ঢিল ছুড়বে, কিছু সময় অতিক্রম হলে একটা পর্যায়ে গিয়ে তারাই আপনাকে ফুল দিবে। তাদের ফুল দিতেও সময় লাগে না, ঢিল দিতেও সময় লাগে না। সময় শুধু সব চেয়ে চেয়ে দেখে, আর ঈষৎ হাসে।

আপনি একা বলে হতাশ হয়ে দমে যেতে নেই। আজ হয়ত আপনি দৈহিকভাবে একা এবং নিঃসঙ্গ ; কিন্তু কাল হয়ত দেখা যাবে লাখোলাখো মানুষের মস্তিষ্কে থাকবে আপনার মৌলিক চিন্তার ভাবপ্রবাহ। নিস্তেজ ছাইয়ের মধ্যে আগুনের বিন্দু পরিমাণ ফুলকিও, কখনো বৃহৎ দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। আজ যিনি একা, যদি তার সৃষ্টিশীল ভাবপ্রবাহ বেঁচে থাকে তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “মদন ভস্মের পরে” কবিতার মদনের মত সবার হৃদয়ে সে আশ্রয় নিবে। পাখিরা সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় অথবা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে আকাশে উড়ে, কিন্তু চিল সঙ্গী না পেলেও আপন গাম্ভীর্য নিয়ে একাই অনন্ত আকাশে উড়ে বেড়ায়।সৃষ্টির অনন্ত আকাশে একাকী চিল নিঃসঙ্গতার আনন্দে উড়ে বেড়ায়। নিঃসঙ্গতা তাকে হতাশ করেনি, অবসন্ন করেনি।সৃষ্টিশীলতা মানুষকে যেমন নিঃসঙ্গ করে, তেমনি নিঃসঙ্গতা মানুষকে প্রচণ্ডভাবে সৃষ্টিশীল করে তোলে। মুদ্রার উভয় পিঠের মত দুটোই একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত। নিজের মুক্ত আকাশে একাকী চিলের মত ভেসে বেড়াতে একটা নান্দনিক স্বর্গীয় আনন্দ আছে। এ মুক্ত আনন্দের আকাশেই জন্ম নেয় সৃষ্টিশীলতার স্বাভিমান।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়