Thursday, May 2, 2024
সম্পাদকীয়

কটক থেকে মা প্রভাবতী দেবীকে লেখা নেতাজির চিঠি

কলকাতা ট্রিবিউন ডেস্ক:

শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়

পরম পূজনীয়া

শ্রীমতী মাতা ঠাকুরানী

শ্রীচরণ কমলেষু

 

মা,

ভারতবর্ষ ভগবানের বড় আদরের স্থান- এই মহাদেশের লোকশিক্ষার নিমিত্ত ভগবান যুগে যুগে অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করিয়া পাপক্লিষ্টা ধরণী পবিত্র করিয়াছেন এবং প্রত্যেক ভারতবাসীর হৃদয়ে ধর্মের ও সত্যের বীজ রোপন করিয়া গিয়াছেন । ভগবান মানব দেহ ধারণ করিয়া নিজের অংশাবতার রূপে অনেক দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু এত বার তিনি কোন দেশে জন্মগ্রহণ করেন নাই- তাই বলি আমাদের জন্মভূমি ভারতমাতা ভগবানের বড় আদরের দেশ। দেখ মা, ভারতে যাহা চাও সবই আছে প্রচন্ড গ্রীষ্ম, দারুন শীত, ভীষণ বৃষ্টি আর মনোহর শরৎ ও বসন্তকাল, সবই আছে। দাক্ষিণাত্যে দেখি স্বচ্ছসলিলা পূণ্যতোয়া গোদাবরী দুই কুল ভরিয়া তর তর কল কল শব্দে নিরন্তর সাগরাভিমুখে চলিয়াছে। কি পবিত্র নদী দেখিবামাত্র ভাবিবামাত্র রামায়ণে পঞ্চবটীর কথা মনে পড়ে? তখন মানসনেত্রে দেখি সেই তিনজন- রাম, লক্ষণ ও সীতা সমস্ত রাজ্য ও সম্পদ ত্যাগ করিয়া, সুখে, মহাসুখে স্বর্গীয় সুখের সহিত গোদাবরী তীরে কলহরণ করিতেছেন- সাংসারিক দুঃখের বা চিন্তার ছায়া আর তাদের প্রসন্ন বদনকমলকে মলিন করিতেছে না- প্রকৃতির উপাসনা ও ভগবানের আরাধনা করিয়া তাহার তিনজনই মহানন্দে কাল কাটাইতেছেন- আর এদিকে আমরা সাংসারিক দুঃখ নিরন্তর পড়িতেছি।

কোথায় সে সুখ, কোথায় সে শান্তি? আমরা শান্তির জন্য হাহাকার করিতেছি! ভগবানের চিন্তন ও পুজন ভিন্ন আর শান্তি নাই। যদি মর্ত্ত্যে কোন সুখ থাকে তাহলে গৃহে গৃহে গোবিন্দের নাম কীর্তন ভিন্ন আর‌ কোনো সুখের উপায় নেই। আবার যখন ঊর্ধ্বে দৃষ্টি তুলি, মা, তখন আরো পবিত্র দৃশ্য দেখি । দেখি পূর্ণ জাহ্নবী সলিলভার বহন করিয়া চলিয়াছে- আবার রামায়ণের আর একটি প্রবিত্র দৃশ্য মনে পড়ে। তখন দেখি বাল্মীকির সেই পবিত্র তপোবন- দিবারাত্র মহর্ষির পবিত্র কণ্ঠদভূত পূত বেদমন্ত্রে শব্দায়িত।দেখি বৃদ্ধ মহর্ষি অজিনাসনে বসে আছেন- তাহার পদতলে দুইটি শিষ্য- কুশ ও লব- মহর্ষি তাহাদিগকে শিক্ষা দিতেছেন ।পবিত্র বেদ ধ্বনিতে আকৃষ্ট হইয়া ক্রুর সর্প ও নিজের বিষ হারাইয়া ফণা তুলিয়া নিরবে মন্ত্রপাঠ শুনিতেছে- গোকুল গঙ্গায় সলিল পান করিবার জন্য আসিয়াছে- তাহারাও একবার মুখ তুলিয়া সেই পবিত্র মন্ত্র ধ্বনি শুনিতেছে- শুনিয়া কর্ণদ্বয় সার্থক করিতেছে । নিকটে হরিণ শুইয়া আছে- সমস্তক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে মহর্ষির মুখপানে চাহিয়া আছে। রামায়নে সবই পবিত্র -সামান্য তৃণেরর বর্ণনা পর্যন্ত পবিত্র, কিন্তু হায়! সেই পবিত্রতা আমরা ধর্মত্যাগী বলিয়া এখন আর বুঝিতে পারিনা।

আরেকটি পবিত্র দৃশ্য মনে পড়িতেছে। ত্রিভুবনতারিণী কলুষহারিণী ভাগীরথী চলিয়াছেন- তাহার তীরে যোগীকুল বসিয়া আছেন- কেহ অর্ধনির্মিলিত নেত্রে প্রাতঃসন্ধ্যায় নিমগ্ন- কেহ কাননের পুষ্পরাজি তুলিয়া প্রতিমা গড়িয়া, চন্দন ধূপ প্রভৃতি সুগন্ধী দ্রব্য দিয়া পূজা করিতেছেন- কেহ মন্ত্রোচ্চারণে দিগদিগন্ত মুখরিত করিতেছেন, কেহ গঙ্গার পবিত্র সলিলে আচমন করিয়া আপনাকে পবিত্র করিতেছেন- কেহ গুন গুন করিতে করিতে পূজার জন্য বনফুল তুলিতেছেন। সকলি পবিত্র- সকলি নয়ন ও মনের প্রীতিকর। কিন্তু হায়! যখন ভাবি সেই পুণ্যশ্লোক ঋষিকুল কোথায়? তাদের সেই পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণ কোথায়? তাদের সেই যাগযজ্ঞ পূজা হোম প্রভৃতি কোথায়? ভাবিলে হৃদয় বিদীর্ণ হয়! আমাদের ধর্ম নাই, কিছুই নাই -জাতীয় জীবন পর্যন্তও নাই। আমরা এখন দুর্বল শরীর পরদাসত্ব-ব্যবসায়ী, নষ্টধর্ম ,পাপীষ্ঠ জাতি! হায়! পরমেশ্বর! সেই ভারতের এখন কি শোচনীয় অবস্থা উপস্থিত ! তুমি কি আমাদের উদ্ধার করিবে না? এ ত তোমারই দেশ -কিন্তু দেখ ভগবান, তোমার দেশের কী অবস্থা! তোমার অবতারগন যে সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন তাহা কোথায়? আমাদের পূর্বপুরুষ আর্যগন, যে জাতি এবং যে ধর্ম গঠিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা এখন ছারখার হইয়াছে। দয়া কর, রক্ষা কর, ওহে দয়াময় হরি!

মা, আমি যখন চিঠি লিখতে বসি তখন পাগলের চেয়েও পাগল। কি লিখিব ভাবিয়া লিখিতে বসি না এবং কি বা লিখিতে পারি তাহা জানি না। মনে যে ভাবটি আগে আসে তাই লিপিবদ্ধ করি- ভাবি না কি লিখিতেছি বা কেনো লিখিতেছি। ইচ্ছে হয় তাই লিখি- মন বলে- লেখ- তাই লিখি। যদি কিছু অসঙ্গত লিখে থাকি তবে আমাকে মার্জনা করিবেন।

পূজ্যপাদ স্বর্গীয় গুরুদেব মহাশয়ের স্বর্গপ্রাপ্তির বিষয় যখন ভাবি তখন দুঃখিত হইবো কি আনন্দিত ভাবিয়া উঠিতে পারিনা। মনুষ্য যখনই পৃথিবী হইতে বিদায় গ্রহণ করে তখন কোথায় যায় বা কিরূপ অবস্থা ভোগ করে তাহা আমরা জানি না। তবে চরমদশায় আমাদের জীবাত্মা ও পরমাত্মার সহিত বিলীন হয়ে যায়- সেদিন আমাদের পক্ষে আনন্দের দিন – কোন দুঃখ নাই- কোন কষ্ট নাই- পুনর্জন্ম কষ্ট আর আমাদের ভোগ করিতে হয় না- তখন আমরা নিত্যানন্দ বিরাজ করি। যখন ভাবি তিনি সেই নিত্যানন্দ ধামে গিয়াছেন- তিনি অমরগণ এর সহিত এক পংক্তিতে বসিয়া স্বর্গীয় সুধা পান করিতেছেন তখন আর দুঃখিত হবার কারণ দেখি না ।তিনি যখন সেই সদানন্দপুরে গিয়া মহাসুখে আছেন তখন আমরা যদি তার সুখেই সুখি হই তবে আমাদের শোকগ্রস্ত হইবার কোন কারন নাই। দয়াময় ভগবান যাহা করেন জগতের মঙ্গলের জন্যই করেন।আমরা প্রথমে বুঝতে পারি নাই কারন তখন ফল ধরে নাই । যখন ফল পাকে তখন আমরা হৃদয়ের ভিতর বুঝিতে পারি “বাস্তবিক দয়াময় হরি যাহা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।” ভগবান যখন তার উদ্দেশ্য সাধন করিবার জন্য আমাদের নিকট হইতে তাহাকে কাড়িয়া লইয়া গিয়েছেন তখন মিছামিছি আমাদের শোকাকুল হওয়া উচিত নহে- কারণ জিনিস তাহারই- তাহারই ইচ্ছা হইলে অমনি তিনি কাড়িয়া লইবেন- আমাদের তাহাতে অধিকার কি আছে।

আবার ভগবানের ইচ্ছায় তিনি যদি তাহার বিপথগামী ভ্রাতৃবৃন্দ কে ধর্মপথ দেখাইবার জন্য এবং পবিত্র সনাতন ধর্মে দীক্ষিত করিবার জন্য পুনরায় মানবদেহ ধারন করিয়া থাকেন তবে তাতেও আমাদের দুঃখিত হওয়া উচিত নহে। কারণ তাতে জগতের কল্যাণ সাধিত হইবে। যাহাতে জগতের কল্যাণ হইবে, আমরা ত বিরোধী হইতে পারিনা। জগতের মঙ্গলই প্রত্যেক মানুষের পক্ষে মঙ্গলকর। আমরা ভারতবাসী ভারতের মঙ্গলই আমাদের মঙ্গল । তিনি যদি পুনরায় জন্ম পরিগ্রহ করিয়া আমাদের ভাতৃকল্প ভারত সন্তানদিগকে ধর্মনিষ্ঠ করিতে পারেন তাহলে আমাদের যারপরনাই আনন্দিত হওয়া উচিত। গীতায় ভগবান স্বয়ং বলিয়াছেন।

“দেহিনোহস্মিন যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।

তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি।।”

আমরা সকলে ভালো আছি। তাহার হাতেই আছি- তিনি যেরূপ রাখিয়াছেন , সেইরূপেই আছি আমরা সকলে তাহার ক্রীড়াপুত্তলি- আমাদের ক্ষমতা কতটুকু- সবই তার ওপর নির্ভর করে । আমরা বাগানের মালি – বাগানের মালিক তিনি । আমরা বাগানে কাজ করি কিন্তু বাগানের ফলে আমাদের কোন অধিকার নেই। আমরা বাগানে কাজ করি বাগানে ফল উৎপন্ন হয় তার চরণে নিবেদন করিয়া দিই। কার্যে আমাদের অধিকার আছে -কার্য আমাদের কর্তব্য – ফল তাহার- আমাদের নয় ।তাই ভগবান গীতায় বলিয়াছেন-

” কর্মন্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”

লিলি এখন কোথায় ও কেমন আছে? জানিনা কোথায় আছে তাই পত্র দিলাম না। মামী মা ও বৌদিদিরা কোথায় ও কেমন আছেন? দাদা কেমন আছেন? অন্যান্য সকলে কেমন আছেন? আপনিও বাবা কেমন আছেন? আপনারা আমার প্রণাম জানিবেন। মেজ দাদার খবর কি? ২|৩ মেলে আমি কোন পত্র পাই নাই। নতুন মামাবাবু কেমন আছেন?শুনিলাম ছোটমামীমার বড় অসুখ হইয়াছে। তিনি কেমন আছেন? সারদা কি বলে?

 

ইতি

আপনারই সেবক

সুভাষ