Friday, May 17, 2024
সম্পাদকীয়

বেহুলা কখনও বিধবা হয় না, এটা বাংলার রীতি

সংগ্রাম দত্ত: প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী, মনসাদেবী বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যদি চম্পাই নগরের চাঁদ সওদাগর তাঁর পূজা দেন তাহলে ত্রিলোকে মনসার পূজা প্রচলিত হবে। কিন্তু চাঁদ সওদাগর মনসা বিদ্বেষী হওয়ায় এতে সে রাজি হয় না। চাঁদ সিংহল বাণিজ্য শেষে ফেরার পথে কালিদাহ সাগরে ঝড় সৃষ্টি করে মনসা। সব জাহাজ জলে তলিয়ে যায়, কিন্তু প্রাণে বেঁচে যায় চাঁদ সওদাগর। ঐ সময়ে তার এক পুত্র জন্ম হয়, নাম লখিন্দর। এক গণক ভবিষ্যৎবাণী করে বলেন বাসর ঘরে লখিন্দরকে সাপ কামড়াবে।

লখিন্দর প্রাপ্ত বয়স্ক হলে বেহুলার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়। তাদের জন্য তৈরি করা হয় লোহার বাসর ঘর। বাসর রাতে মনসা সুতার আকার ধারণ করে ঘরে ঢুকে দংশন করে লখিন্দরকে। সে যুগের রীতি, সাপে কাটা দেহ ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া। লখিন্দরের সঙ্গে ভাসানো হয় বেহুলাকেও। ছয় মাস জলে ভাসতে ভাসতে পচন শুরু হয় লখিন্দরের দেহে। বেহুলা মনসার কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে প্রার্থনা করতে থাকে। একদা ভেলা পৌঁছে এক ঘাটে। সেখানে বাস করতো মনসার পালক মাতা নিতা। নিতা ঘাটে বসে দেখে বেহুলার প্রার্থনা। তার মন গলে যায়। শেষে নিতা অলৌকিক ক্ষমতায় বেহুলা ও লখিন্দরকে স্বর্গে নিয়ে যায়। চোখ খুলে বেহুলা দেখতে পায় মনসাকে। মনসা বলে, ‘তোমার স্বামীকে ফিরে পেতে হলে, তোমার শ্বশুরকে আমার পূজারী হতে হবে।’ বেহুলা রাজি হয়। সাথে সাথে চোখ মেলে তাকায় লখিন্দর। নিতার সাহায্যে আবার মর্ত্যে ফিরে আসে বেহুলা। শ্বশুরকে সব ঘটনা বললে সে মনসার পূজায় সম্মত হয়।

কিংবদন্তির সেই বেহুলা বর্তমান বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার বিনসাড়া গ্রামের এক জমিদারবাড়ির কন্যা ছিলেন বলে এ অঞ্চলে জনশ্রুতি আছে। বেহুলার বাবা সায় সওদাগর। সিরাজগঞ্জের তাড়াশে তার পৈতৃক ভিটায় আছে জীয়নকূপ আর বগুড়ার গোকূলে টিকে আছে তার বাসরঘর। বগুড়ার গোকুলমেধ স্থানটি বেহুলার বাসরঘর বা লখিন্দরের মেধ নামেও পরিচিত। বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের ৩ কিমি দক্ষিণে গোকুল গ্রামে এই প্রত্নস্থলটি। বেহুলা-লখিন্দরের বাসর ঘর বলে এটি জনসাধারণের কাছে পরিচিত।

১৯৩৪-৩৬ সালে খননের ফলে এখানে এক বিশাল স্তুপ বা মন্দিরের ভিত্তি উন্মোচিত হয়। ভিত্তিটি স্তরে স্তরে উঁচু করে কুঠুরি নির্মাণ রীতিতে নির্মিত। এতে ১৭২টি কুঠুরি বিভিন্ন তলে মাটি ভরাট করে নিচ থেকে উপরে ক্রমহ্রাসমান করে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে এগুলো কোনো সুউচ্চ মন্দির বা স্তূপের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এরূপ স্তরে উঁচু করা বহুতল সমান্তরাল ঠেস দেওয়ালযুক্ত ভিতের উপর স্থাপত্য নির্মাণ প্রাচীন বাংলার তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য। গবেষকদের মতে, এটি ৮০৯- ৮৪৭ সালে দেবপাল নির্মিত একটি মঠ। এ স্তূপটি বাসরঘর নয়। এর পশ্চিমার্ধে আছে বাসরঘরের প্রবাদ স্মৃতিচিহ্ন। পূর্বার্ধে ২৪ কোণবিশিষ্ট চৌবাচ্চা সদৃশ একটি বাথরুম যাতে ছিল ৮ ফুট গভীর এক কূপ। কথিত আছে, বেহুলা লখিন্দর মধুনিশি যাপনের পর কূপের জলে স্নান করে শুদ্ধতা লাভ করতেন। লোককথার বেহুলা- লখিন্দর নেই কিন্তু এ স্থাপনাকে ঘিরে মানুষের মনে জেগে আছে তাদের প্রেমের কল্পনাশ্রয়ী জনশ্রুতি।