Sunday, May 19, 2024
ব্লগ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয় কয়েকটি গান ও কবিতা

১. বিপদে মোরে রক্ষা করো

বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে
নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।
সহায় মোর না যদি জুটে
নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি
লভিলে শুধু বঞ্চনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।

আমারে তুমি করিবে ত্রাণ
এ নহে মোর প্রার্থনা,
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।
আমার ভার লাঘব করি
নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
বহিতে পারি এমনি যেন হয়।
নম্রশিরে সুখের দিনে
তোমারি মুখ লইব চিনে,
দুখের রাতে নিখিল ধরা
যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়।

 

২. আমাদের ছোট নদী

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।

চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।

আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।

 

৩. মেঘের পরে মেঘ জমেছে

মেঘের ‘পরে মেঘ জমেছে,
             আঁধার করে আসে,
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
             একা দ্বারের পাশে।
                           কাজের দিনে নানা কাজে
                           থাকি নানা লোকের মাঝে,
                           আজ আমি যে বসে আছি
         তোমারি আশ্বাসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
            একা দ্বারের পাশে।
 
তুমি যদি না দেখা দাও,
            কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার
            এমন বাদল-বেলা।
    দূরের পানে মেলে আঁখি
    কেবল আমি চেয়ে থাকি,
                    পরান আমার কেঁদে বেড়ায়
        দুরন্ত বাতাসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
         একা দ্বারের পাশে।
৪. আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে–
              আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।
                  এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি
                  পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
                         নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে
                         আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।
              রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ‘পরে
              নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।
       এসেছে এসেছে এই কথা বলে প্রাণ,
       এসেছে এসেছে উঠিতেছে এই গান,
              নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে।
              আবার আষাঢ় এসেছে আকাশ ছেয়ে।
৫. প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে
প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে।
সকল দ্বন্দ্ব ঘুচবে আমার তবে।
       আর-যাহারা আসে আমার ঘরে
       ভয় দেখায়ে তারা শাসন করে,
           দুরন্ত মন দুয়ার দিয়ে থাকে,
               হার মানে না, ফিরায়ে দেয় সবে।
সে এলে সব আগল যাবে ছুটে,
সে এলে সব বাঁধন যাবে টুটে,
    ঘরে তখন রাখবে কে আর ধরে
        তার ডাকে যে সাড়া দিতেই হবে।
       আসে যখন, একলা আসে চলে,
       গলায় তাহার ফুলের মালা দোলে,
           সেই মালাতে বাঁধবে যখন টেনে
               হৃদয় আমার নেরব হয়ে রবে।
৬. শেষের মধ্যে অশেষ আছে
শেষের মধ্যে অশেষ আছে,
     এই কথাটি মনে
আজকে আমার গানের শেষে
       জাগছে ক্ষণে ক্ষণে।
                           সুর গিয়েছে থেমে তবু
                           থামতে যেন চায় না কভু,
                           নীরবতায় বাজছে বীণা
                                  বিনা প্রয়োজনে।
তারে যখন আঘাত লাগে,
             বাজে যখন সুরে–
সবার চেয়ে বড়ো যে গান
             সে রয় বহুদূরে।
                           সকল আলাপ গেলে থেমে
                           শান্ত বীণায় আসে নেমে,
                           সন্ধ্যা যেমন দিনের শেষে
                                  বাজে গভীর স্বনে।
৭. ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা
ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা,
       মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা।
              সারা জনম তোমার লাগি
              প্রতিদিন যে আছি জাগি,
       তোমার তরে বহে বেড়াই
                    দুঃখসুখের ব্যথা।
       মরণ, আমার মরণ, তুমি
                  কও আমারে কথা।
       যা পেয়েছি, যা হয়েছি
                    যা-কিছু মোর আশা।
       না জেনে ধায় তোমার পানে
                    সকল ভালোবাসা।
              মিলন হবে তোমার সাথে,
              একটি শুভ দৃষ্টিপাতে,
       জীবনবধূ হবে তোমার
              নিত্য অনুগতা;
       মরণ, আমার মরণ, তুমি
             কও আমারে কথা।
                           বরণমালা গাঁথা আছে,
                                         আমার চিত্তমাঝে,
                           কবে নীরব হাস্যমুখে
                                         আসবে বরের সাজে।
                                সেদিন আমার রবে না ঘর,
                                কেই-বা আপন, কেই-বা অপর,
                           বিজন রাতে পতির সাথে
                                    মিলবে পতিব্রতা।
                           মরণ, আমার মরণ, তুমি
                                     কও আমারে কথা।
৮. সোনার তরী
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
     কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
            রাশি রাশি ভারা ভারা
            ধান কাটা হল সারা,
            ভরা নদী ক্ষুরধারা
                    খরপরশা।
     কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
     একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
     চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
            পরপারে দেখি আঁকা
            তরুছায়ামসীমাখা
            গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
                    প্রভাতবেলা–
     এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
     গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
     দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
            ভরা-পালে চলে যায়,
            কোনো দিকে নাহি চায়,
            ঢেউগুলি নিরুপায়
                    ভাঙে দু-ধারে–
     দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,
     বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
            যেয়ো যেথা যেতে চাও,
            যারে খুশি তারে দাও,
            শুধু তুমি নিয়ে যাও
                    ক্ষণিক হেসে
     আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
     যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
     আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি ভরে।
            এতকাল নদীকূলে
            যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
            সকলি দিলাম তুলে
                    থরে বিথরে–
     এখন আমারে লহ করুণা করে।
     ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী
     আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
            শ্রাবণগগন ঘিরে
            ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
            শূন্য নদীর তীরে
                    রহিনু পড়ি–
     যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
৯. দুই পাখি
খাঁচার পাখি ছিল     সোনার খাঁচাটিতে
               বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া     মিলন হল দোঁহে,
        কী ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে,  খাঁচার পাখি ভাই,
       বনেতে যাই দোঁহে মিলে।
খাঁচার পাখি বলে– বনের পাখি, আয়
        খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।’
                 বনের পাখি বলে– “না,
আমি     শিকলে ধরা নাহি দিব।’
        খাঁচার পাখি বলে– “হায়,
আমি     কেমনে বনে বাহিরিব!’
বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি
                 বনের গান ছিল যত,
খাঁচার পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার–
                 দোঁহার ভাষা দুইমতো।
বনের  পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,
        বনের গান গাও দিখি।
খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি ভাই,
খাঁচার গান লহো শিখি।
          বনের পাখি বলে– না,
আমি     শিখানো গান নাহি চাই।’
        খাঁচার পাখি বলে– “হায়,
আমি     কেমনে বন-গান গাই।’
         বনের পাখি বলে, “আকাশ ঘননীল,
        কোথাও বাধা নাহি তার।’
খাঁচার পাখি বলে, “খাঁচাটি পরিপাটি
        কেমন ঢাকা চারি ধার।’
বনের পাখি বলে, “আপনা ছাড়ি দাও
        মেঘের মাঝে একেবারে।’
খাঁচার পাখি বলে, নিরালা সুখকোণে
        বাঁধিয়া রাখো আপনারে!’
        বনের পাখি বলে– “না,
সেথা     কোথায় উড়িবারে পাই!’
        খাঁচার পাখি বলে– “হায়,
মেঘে     কোথায় বসিবার ঠাঁই!’
এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে
        তবুও কাছে নাহি পায়।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে,
        নীরবে চোখে চোখে চায়।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,
        বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা,
        কাতরে কহে, “কাছে আয়!’
        বনের পাখি বলে–না,
কবে     খাঁচার রুধি দিবে দ্বার।
        খাঁচার পাখি বলে–হায়,
মোর     শকতি নাহি উড়িবার।
১০. পরশ-পাথর
খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
   মাথায় বৃহৎ জটা                 ধূলায় কাদায় কটা,
        মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর।
   ওষ্ঠে অধরেতে চাপি            অন্তরের দ্বার ঝাঁপি
        রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে।
   দুটো নেত্র সদা যেন             নিশার খদ্যোত-হেন
        উড়ে উড়ে খোঁজে কারে নিজের আলোকে।
   নাহি যার চালচুলা            গায়ে মাখে ছাইধুলা
        কটিতে জড়ানো শুধু ধূসর কৌপীন,
   ডেকে কথা কয় তারে        কেহ নাই এ সংসারে
        পথের ভিখারি হতে আরো দীনহীন,
   তার এত অভিমান,            সোনারুপা তুচ্ছজ্ঞান,
        রাজসম্পদের লাগি নহে সে কাতর,
   দশা দেখে হাসি পায়          আর কিছু নাহি চায়
        একেবারে পেতে চায় পরশপাথর!
        সম্মুখে গরজে সিন্ধু অগাধ অপার।
   তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি                 হেসে হল কুটিকুটি
        সৃষ্টিছাড়া পাগলের দেখিয়া ব্যাপার।
আকাশ রয়েছে চাহি,           নয়নে নিমেষ নাহি,
        হু হু করে সমীরণ ছুটেছে অবাধ।
সূর্য ওঠে প্রাতঃকালে           পূর্ব গগনের ভালে,
        সন্ধ্যাবেলা ধীরে ধীরে উঠে আসে চাঁদ।
জলরাশি অবিরল                 করিতেছে কলকল,
        অতল রহস্য যেন চাহে বলিবারে।
কাম্য ধন আছে কোথা        জানে যেন সব কথা,
        সে-ভাষা যে বোঝে সেই খুঁজে নিতে পারে।
কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাহি,        মহা গাথা গান গাহি
        সমুদ্র আপনি শুনে আপনার স্বর।
কেহ যায়, কেহ আসে,        কেহ কাঁদে, কেহ হাসে,
        খ্যাপা তীরে খুঁজে ফিরে পরশ-পাথর।
        একদিন, বহুপূর্বে, আছে ইতিহাস–
নিকষে সোনার রেখা            সবে যেন দিল দেখা–
        আকাশে প্রথম সৃষ্টি পাইল প্রকাশ।
মিলি যত সুরাসুর                  কৌতূহলে ভরপুর
        এসেছিল পা টিপিয়া এই সিন্ধুতীরে।
অতলের পানে চাহি                নয়নে নিমেষ নাহি
        নীরবে দাঁড়ায়ে ছিল স্থির নতশিরে।
বহুকাল স্তব্ধ থাকি               শুনেছিল মুদে আঁখি
        এই মহাসমুদ্রের গীতি চিরন্তন;
তার পরে কৌতূহলে           ঝাঁপায়ে অগাধ জলে
        করেছিল এ অনন্ত রহস্য মন্থন।
বহুকাল দুঃখ সেবি                নিরখিল, লক্ষ্মীদেবী
        উদিলা জগৎ-মাঝে অতুল সুন্দর।
সেই সমুদ্রের তীরে                  শীর্ণ দেহে জীর্ণ চীরে
        খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
        এতদিনে বুঝি তার ঘুচে গেছে আশ।
খুঁজে খুঁজে ফিরে তবু          বিশ্রাম না জানে কভু,
        আশা গেছে, যায় নাই খোঁজার অভ্যাস।
বিরহী বিহঙ্গ ডাকে               সারা নিশি তরুশাখে,
        যারে ডাকে তার দেখা পায় না অভাগা।
তবু ডাকে সারাদিন              আশাহীন শ্রান্তিহীন,
        একমাত্র কাজ তার ডেকে ডেকে জাগা।
আর-সব কাজ ভুলি            আকাশে তরঙ্গ তুলি
        সমুদ্র না জানি কারে চাহে অবিরত।
যত করে হায় হায়           কোনোকালে নাহি পায়,
        তবু শূন্যে তোলে বাহু, ওই তার ব্রত।
কারে চাহি ব্যোমতলে           গ্রহতারা লয়ে চলে,
        অনন্ত সাধনা করে বিশ্বচরাচর।
সেইমতো সিন্ধুতটে                ধূলিমাথা দীর্ঘজটে
        খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
        একদা শুধাল তারে গ্রামবাসী ছেলে,
“সন্ন্যাসীঠাকুর, এ কী,         কাঁকালে ও কী ও দেখি,
        সোনার শিকল তুমি কোথা হতে পেলে।’
সন্ন্যাসী চমকি ওঠে               শিকল সোনার বটে,
        লোহা সে হয়েছে সোনা জানে না কখন।
একি কাণ্ড চমৎকার,            তুলে দেখে বার বার,
        আঁখি কচালিয়া দেখে এ নহে স্বপন।
কপালে হানিয়া কর               বসে পড়ে ভূমি-‘পর,
        নিজেরে করিতে চাহে নির্দয় লাঞ্ছনা;
পাগলের মতো চায়–           কোথা গেল, হায় হায়,
        ধরা দিয়ে পলাইল সফল বাঞ্ছনা।
কেবল অভ্যাসমত                  নুড়ি কুড়াইত কত,
        ঠন্‌ ক’রে ঠেকাইত শিকলের ‘পর,
চেয়ে দেখিত না, নুড়ি          দূরে ফেলে দিত ছুঁড়ি,
        কখন ফেলেছে ছুঁড়ে পরশ-পাথর।
        তখন যেতেছে অস্তে মলিন তপন।
আকাশ সোনার বর্ণ,              সমুদ্র  গলিত স্বর্ণ,
        পশ্চিম দিগ্বধূ দেখে সোনার স্বপন।
সন্ন্যাসী আবার ধীরে               পূর্বপথে যায় ফিরে
        খুঁজিতে নূতন ক’রে হারানো রতন।
সে শকতি নাহি আর                 নুয়ে পড়ে দেহভার
        অন্তর লুটায় ছিন্ন তরুর মতন।
পুরাতন দীর্ঘ পথ                 পড়ে আছে মৃতবৎ
        হেথা হতে কত দূর নাহি তার শেষ।
দিক হতে দিগন্তরে               মরুবালি ধূ ধূ করে,
        আসন্ন রজনী-ছায়ে ম্লান সর্বদেশ।
অর্ধেক জীবন খুঁজি              কোন্‌ ক্ষণে চক্ষু বুজি
        স্পর্শ লভেছিল যার এক পল ভর,
বাকি অর্ধ ভগ্ন প্রাণ              আবার করিছে দান
        ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশ-পাথর।
১১. যেতে নাহি দিব
দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি; বেলা দ্বিপ্রহর;
          হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর।
          জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
          মধ্যাহ্ন-বাতাসে; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায়
          ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি
          ঘুমায়ে পড়েছে; যেন রৌদ্রময়ী রাতি
          ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম–
          শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম।
          গিয়েছে আশ্বিন– পূজার ছুটির শেষে
          ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে
          সেই কর্মস্থানে। ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
          বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে,
          হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে।
          ঘরের গৃহিণী, চক্ষু ছলছল করে,
          ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার,
          তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
          একদণ্ড তরে; বিদায়ের আয়োজনে
          ব্যস্ত হয়ে ফিরে; যথেষ্ট না হয় মনে
          যত বাড়ে বোঝা। আমি বলি, “এ কী কাণ্ড!
          এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড
          বোতল বিছানা বাক্স  রাজ্যের বোঝাই
          কী করিব লয়ে  কিছু এর রেখে যাই
          কিছু লই সাথে।’
                          সে কথায় কর্ণপাত
          নাহি করে কোনো জন। “কী জানি দৈবাৎ
          এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
          তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে?
          সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান;
         ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
          গুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনা নারিকেল;
           দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল;
           আমসত্ত্ব আমচুর; সের দুই দুধ–
           এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ।
           মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে,
           মাথা খাও, ভুলিয়ো না, খেয়ো মনে করে।’
           বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয়।
           বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায়।
           তাকানু ঘড়ির পানে, তার পরে ফিরে
           চাহিনু প্রিয়ার মুখে; কহিলাম ধীরে,
           “তবে আসি’। অমনি ফিরায়ে মুখখানি
            নতশিরে চক্ষু-‘পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি
            অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন।
            বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
            কন্যা মোর চারি বছরের। এতক্ষণ
            অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন,
            দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
            মুদিয়া আসিত ঘুমে; আজি তার মাতা
            দেখে নাই তারে; এত বেলা হয়ে যায়
            নাই স্নানাহার। এতক্ষণ ছায়াপ্রায়
            ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে,
            চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
            বিদায়ের আয়োজন। শ্রান্তদেহে এবে
            বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে
            চুপিচাপি বসে ছিল। কহিনু যখন
            “মা গো, আসি’ সে কহিল বিষণ্ণ-নয়ন
            ম্লান মুখে, “যেতে আমি দিব না তোমায়।’
            যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায়,
            ধরিল না বাহু মোর, রুধিল না দ্বার,
            শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার
            প্রচারিল–“যেতে আমি দিব না তোমায়’।
            তবুও সময় হল শেষ, তবু হায়
            যেতে দিতে হল।
                                ওরে মোর মূঢ় মেয়ে,
            কে রে তুই, কোথা হতে কী শকতি পেয়ে
            কহিলি এমন কথা, এত স্পর্ধাভরে–
            “যেতে আমি দিব না তোমায়’? চরাচরে
            কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
            গরবিনী, সংগ্রাম করিবি কার সাথে
            বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্ত ক্ষুদ্র দেহ
            শুধু লয়ে ওইটুকু বুকভরা স্নেহ।
            ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
            মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে
            এ জগতে, শুধু বলে রাখা “যেতে দিতে
            ইচ্ছা নাহি’। হেন কথা কে পারে বলিতে
            “যেতে নাহি দিব’! শুনি তোর শিশুমুখে
            স্নেহের প্রবল গর্ববাণী, সকৌতুকে
            হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেল মোরে,
            তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভ’রে
            দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন,
            আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন।
             চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
             শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে
             রৌদ্র পোহাইছে। তরুশ্রেণী উদাসীন
             রাজপথপাশে, চেয়ে আছে সারাদিন
             আপন ছায়ার পানে। বহে খরবেগ
             শরতের ভরা গঙ্গা। শুভ্র খণ্ডমেঘ
             মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত
             সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মতো
             নীলাম্বরে শুয়ে। দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত
             যুগ-যুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত
             ধরণীর পানে চেয়ে ফেলিনু নিশ্বাস।
              কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
              সমস্ত পৃথিবী। চলিতেছি যতদূর
              শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
              “যেতে আমি দিব না তোমায়’। ধরণীর
              প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
              ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে,
              “যেতে নাহি দিব। যেতে নাহি দিব।’ সবে
               কহে “যেতে নাহি দিব’। তৃণ ক্ষুদ্র অতি
               তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
               কহিছেন প্রাণপণে “যেতে নাহি দিব’।
               আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব,
               আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে
               কহিতেছে শত বার “যেতে দিব না রে’।
               এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
                সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে
                গভীর ক্রন্দন–“যেতে নাহি দিব’।   হায়,
                তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
                চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে।
                প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
                প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
                “দিব না দিব না যেতে’ ডাকিতে ডাকিতে
                হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে
                পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে।
                সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
                “দিব না দিব না যেতে’– নাহি শুনে কেউ
                নাহি কোনো সাড়া।
                                   চারি দিক হতে আজি
                 অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি
                 সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন
                 মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে; শিশুর মতন
                 বিশ্বের অবোধ বাণী। চিরকাল ধরে
                 যাহা পায় তাই সে হারায়, তবু তো রে
                 শিথিল হল না মুষ্টি, তবু অবিরত
                 সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো
                 অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি
                 “যেতে নাহি দিব’। ম্লান মুখ, অশ্রু-আঁখি,
                 দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব,
                 তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব,
                 তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয়
                 “যেতে নাহি দিব’। যত বার পরাজয়
               তত বার কহে, “আমি ভালোবাসি যারে
                 সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।
                 আমার আকাঙক্ষা-সম এমন আকুল,
                 এমন সকল-বাড়া, এমন অকূল,
                 এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর!’
                 এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার
                 “যেতে নাহি দিব’। তখনি দেখিতে পায়,
                 শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি-সম উড়ে চলে যায়
                 একটি নিশ্বাসে তার আদরের ধন;
                 অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন,
                 ছিন্নমূল তরু-সম পড়ে পৃথ্বীতলে
                 হতগর্ব নতশির। তবু প্রেম বলে,
                 “সত্যভঙ্গ হবে না বিধির। আমি তাঁর
                 পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার
                 চির-অধিকার-লিপি।’– তাই স্ফীত বুকে
                 সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে
                 দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা
                 বলে, “মৃত্যু তুমি নাই।– হেন গর্বকথা!
                 মৃত্যু হাসে বসি। মরণপীড়িত সেই
                 চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
                 অনন্ত সংসার, বিষণ্ণ নয়ন-‘পরে
                 অশ্রুবাষ্প-সম, ব্যাকুল আশঙ্কাভরে
                 চির-কম্পমান। আশাহীন শ্রান্ত আশা
                 টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা
                 বিশ্বময়। আজি যেন পড়িছে নয়নে–
                 দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে
                 জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে,
                 স্তব্ধ সকাতর। চঞ্চল স্রোতের নীরে
                 পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া–
                 অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্‌ মেঘের সে মায়া।
               তাই আজি শুনিতেছি তরুরক মর্মরে
                 এত ব্যাকুলতা; অলস ঔদাস্যভরে
                 মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা করে
                 শুষ্ক পত্র লয়ে; বেলা ধীরে যায় চলে
                 ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে।
                 মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
                 বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে; শুনিয়া উদাসী
                 বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
                 দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে
                 একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল
                 বক্ষে টানি দিয়া; স্থির নয়নযুগল
                 দূর নীলাম্বরে মগ্ন; মুখে নাহি বাণী।
                 দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি
                 সেই দ্বারপ্রান্তে লীন, স্তব্ধ মর্মাহত
                 মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো।
১২. মুক্তি
চক্ষু কর্ণ বুদ্ধি মন সব রুদ্ধ করি,
বিমুখ হইয়া সর্ব জগতের পানে,
শুদ্ধ আপনার ক্ষুদ্র আত্মাটিরে ধরি
মুক্তি-আশে সন্তরিব কোথায় কে জানে!
পার্শ্ব দিয়ে ভেসে যাবে বিশ্বমহাতরী
অম্বর আকুল করি যাত্রীদের গানে,
শুভ্র কিরণের পালে দশ দিক ভরি’,
বিচিত্র সৌন্দর্যে পূর্ণ অসংখ্য পরানে।
ধীরে ধীরে চলে যাবে দূর হতে দূরে
অখিল ক্রন্দন-হাসি আঁধার-আলোক,
বহে যাবে শূন্যপথে সকরুণ সুরে
অনন্ত-জগৎ-ভরা যত দুঃখশোক।
বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে
আমি একা বসে রব মুক্তি-সমাধিতে?
১৩. তুমি কি কেবল ছবি শুধু পটে লিখা

তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।

              ওই-যে সুদূর নীহারিকা

          যারা করে আছে ভিড়   আকাশের নীড়,

              ওই যারা দিনরাত্রি

আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী   গ্রহ তারা রবি,

          তুমি কি তাদের মতো সত্য নও।

                        হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি॥

              নয়নসমুখে তুমি নাই,

          নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই– আজি তাই

              শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।

আমার নিখিল   তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।

                        নাহি জানি, কেহ নাহি জানে–

                   তব সুর বাজে মোর গানে,

                        কবির অন্তরে তুমি কবি–

                   নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি॥

 

 

১৪. আমি যে বেসেছি ভালো এই জগতেরে

আমি যে বেসেছি ভালো এই জগতেরে;

          পাকে পাকে ফেরে ফেরে

        আমার জীবন দিয়ে জড়ায়েছি এরে;

              প্রভাত-সন্ধ্যার

              আলো-অন্ধকার

          মোর চেতনায় গেছে ভেসে;

               অবশেষে

     এক হয়ে গেছে আজ আমার জীবন

          আর আমার ভুবন।

     ভালোবাসিয়াছি এই জগতের আলো

          জীবনেরে তাই বাসি ভালো।

     তবুও মরিতে হবে এও সত্য জানি।

              মোর বাণী

     একদিন এ-বাতাসে ফুটিবে না,

     মোর আঁখি এ-আলোকে লুটিবে না,

              মোর হিয়া ছুটিবে না

              অরুণের উদ্দীপ্ত আহ্বানে;

                       মোর কানে কানে

          রজনী কবে না তার রহস্যবারতা,

     শেষ করে যেতে হবে শেষ দৃষ্টি, মোর শেষ কথা।

              এমন একান্ত করে চাওয়া

                    এও সত্য যত

              এমন একান্ত ছেড়ে যাওয়া

                    সেও সেই মতো।

     এ দুয়ের মাঝে তবু কোনোখানে আছে কোনো মিল;

                            নহিলে নিখিল

                    এতবড়ো নিদারুণ প্রবঞ্চনা

     হাসিমুখে এতকাল কিছুতে বহিতে পারিত না।

                            সব তার আলো

     কীটে-কাটা পুষ্পসম এতদিনে হয়ে যেত কালো।

 

 

১৫. আজ প্রভাতের আকাশটি এই

আজ প্রভাতের আকাশটি এই

                            শিশির-ছলছল,

          নদীর ধারের ঝাউগুলি ওই

                            রৌদ্রে ঝলমল,

                    এমনি নিবিড় করে

          এরা    দাঁড়ায় হৃদয় ভরে

                            তাই তো আমি জানি

     বিপুল   বিশ্বভুবনখনি

          অকূল মানস-সাগরজলে

                     কমল টলমল।

                 তাই তো আমি জানি

     আমি    বাণীর সাথে বাণী,

     আমি    গানের সাথে গান,

     আমি    প্রাণের সাথে প্রাণ,

     আমি    অন্ধকারের হৃদয়-ফাটা

                    আলোক জ্বলজ্বল।