Monday, May 6, 2024
সম্পাদকীয়

মহাভারতের গদাধারী বীর বিক্রম ভীম কৃষি দেবতা হিসেবে বাংলার মানুষের কাছে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন

সংগ্রাম দত্ত: কেমন হবে, যদি বলা হয় মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডদের মাঝে এক পরাক্রমশালী বীর বাংলার গ্রামীণ জনপদেরই একজন লৌকিক কৃষিদেবতা রূপে অক্ষয় হয়ে আছেন? বলছি বায়ুপুত্র ভীম এর কথা। সেই ভীম, যিনি পরাজিত করেছিলেন বকরাক্ষস, জরাসন্ধ, কিচক, হিড়িম্ব আর কৌরব বাহিনীকে।

ভীমপুজো পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলা ও তার আশেপাশের অঞ্চলের অনন্য এক লোক উৎসব। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে ভীম পূজা হয়। উন্মুক্ত মাঠ, ক্ষেতের ধারে, গ্রামের সীমান্তে, হাট-বাজারে, অথবা রাস্তার মোড়ে মূর্তি তৈরি করে ভীমপূজা অনুষ্ঠিত হয়। গদা হাতে দণ্ডায়মান ভীমের বলিষ্ঠ মূর্তির অধিক প্রচলন থাকলেও, ভীমের বীরত্বব্যঞ্জক বিভিন্ন ঘটনা অবলম্বনে বিভিন্ন প্রকার মূর্তি গঠিত হয়, যার মধ্যে আছে- গদাহস্তে একা ভীম, ভীমের জরাসন্ধ বধ ও কিচক বধ, দুর্যোধনের উরু ভঙ্গ, জতুগৃহ থেকে পলায়ন, হনুমানের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা, দুঃশাসনের রক্তপান, ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ, অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধ প্রভৃতি মৃতি প্রধান। ভীমের মূর্তি সাধারণত স্বর্ণাভ হলুদ, রক্তাক্ত খয়েরী বা ধূসর বর্ণের হয়। মূর্তির মাথায় দীর্ঘ কুঞ্চিত বাবরি চুল এবং মুখে দীর্ঘ জুলফি ও গোঁফ থাকে। আয়ুধ হিসাবে হাতে থাকে গদা। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে সার্বজনীন রূপে ভীমপূজা হয়। 

স্থানভেদে ভীমপূজা অনুষ্ঠিত হয় দিনে, সন্ধ্যায় বা রাত্রে। সাধারণত একাদশীর তিথিতে পূজা হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে রাত্রে চার প্রহরে চারবার পূজা হয়। ভীমপূজায় আতপচাল, ফলমূল ও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির নৈবেদ্য দেওয়া হয়। পূজায় লেবু, নারিকেল, শস্য লাল আলু- প্রভৃতি কাঁচা কলা, শুনবিহীন পাল আলু ও মুগডাল সিদ্ধ, লুচি, বাতাসা, তিলে পাটালি, সন্দেশ প্রভৃতি এবং শীতল ও মকর দেওয়ার প্রথা প্রচলিত আছে। 

ভীমপূজায় কোন কোন ক্ষেত্রে অব্রাহ্মণ পূজারী দেখা গেলেও বর্তমানে সাধারণত ব্রাহ্মণ পুরোহিতই ভীমপূজা করেন এবং স্থানীয় অন্তত একজন উপবাসী থাকেন। পুজায় স্থানীয় সর্বশ্রেণীর অধিবাসী অংশ গ্রহণ করেন। পুজায় ঢাক কাঁসি, শঙ্খ প্রভৃতির বাজান হয়। মজার বিষয় হচ্ছে ভীমপূজার দিন – হালচাষ, ঢেঁকির কাজ, হাতুড়ি-হাপরের কাজ, চুলদাড়ি কাটা, কাপড় কাচা প্রভৃতির আনুষ্ঠানিক বন্ধ (ট্যাবু) প্রতিপালিত হয়। পূজার শেষে ভীমের জলঘট বিসর্জিত হলেও, মূর্তি বিসর্জন করা হয় না। উচ্চ ব্রাহ্মণ প্রভাবিত অঞ্চলে ভীমপুজায় নানা প্রকার শাস্ত্রীয় মন্ত্রের প্রাধান্য দেখা যায়। তবে জনসাধারণের জন্য অনুষ্ঠিত পূজায় শাস্ত্রীয় বিধি-বিধানের আধিক্য দেখা যায় না। যদিও এতে ঊৎসব আয়োজন এর কোনো কমতি হয় না। কিছু জায়গায় ভীমপূজা উপলক্ষে মেলা সংগঠিত হয়, যা এক থেকে সাত-আট দিন পর্যন্ত চলে এবং ভীমপূজা উপলক্ষে লাঠিখেলা, ব্যায়াম প্রদর্শনী, সার্কাস, থিয়েটার, যাত্রা, পুতুল নাচ প্রভৃতি আয়োজিত হয়। 

মাঘ মাসের শুক্লাপক্ষের একাদশী তিথি ভৈমী বা ভীম একদশীরূপে চিহ্নিত। এই ভৈমী একাদশী সম্পর্কে মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কিংবদন্তী প্রচলিত দেখা যায়। শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে নির্জলা উপবাসে যে একদশী পালন করে বিষ্ণুপূজার শেষে ভীম জরাসন্ধকে বধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই একাদশীর নামই হচ্ছে ভীম-একাদশী। গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত আরেকটি গল্প হচ্ছে- মাতা কুন্তী একবার মাঘ মাসে পুকুরের জল অত্যন্ত ঠাণ্ডা থাকায় কিছুতেই স্নান করতে কিংবা একাদশীর ব্রত পালন করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। তখন পাশের ক্ষেত থেকে উঠে এসে ভীম লাঙলের ফলা গরম করে পুকুরের জলে ডুবিয়ে জল গমন করে দেন এবং মাতা কুন্তীর একাদশী পালনে সহায়তা করেন। তখন থেকে কুন্তীর আদেশে, বিষ্ণুর নির্দেশে এই একাদশী ভীম-একাদশী নামে পরিচিত হয়। অন্য আরেকটি কিংবদন্তি হচ্ছে মাঘ মাসের শেষে বৃষ্টিতে ভিজে ভীম যেদিন প্রথম মর্ত্যে চাষের কাজ শুরু করেছিলেন সেই দিনটি ছিল মাঘ মাসের শুক্লা একাদশী, ওই দিনটির স্মরণে প্রতি বৎসর ভীম একাদশী প্রতিপালিত হয়। 

মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় মহাভারত ও ভীম সম্পর্কিত নানা প্রকার কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। লৌকিক প্রবচনে দেখা যায়–

“শয়ন উত্থান পাশমোড়া

তার মধ্যে ভীমে ছোড়া।”

মেদিনীপুর-বাঁকুড়ার সীমান্ত অঞ্চলটি লোকশ্রুতিতে ভীম ও বকরাক্ষসের যুদ্ধক্ষেত্ররূপে পরিচিত। বগড়ি-রুকনগরের নিকটস্থ একারিয়া গ্রাম পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতবাসকালের একচক্রারূপে পরিচিত, এবং শোনা যায় একারিয়া নিকটস্থ ভিকনগর গ্রামে পাণ্ডবগণ ভিক্ষা করতেন। মেদিনীপুরে অবস্থিত দাতনের নিকটে একটি পুকুর ভীমের পদাঘাতে সৃষ্ট হয়েছে বলে শোনা যায়। খড়গপুরের কাছে ইন্দ গ্রামের খড়েগশ্বর মন্দিরের পাশে এক বিশাল প্রান্তর পরিচিত আছে হিড়িম্বাডাঙা নামে- জনশ্রুতি হলো, এই জায়গায় হিড়িম্বর সঙ্গে ভীমের যুদ্ধ হয়েছিল এবং এখানেই ভীম হিড়িম্বাকে বিবাহ করেছিলেন। এছাড়া গণগনির ভাঙা প্রভৃতি স্থানে মাটিতে থাকা ফাটলকে ভীমের গদার আঘাতের বা লাঙল চালানোর ফাটল বলে বর্ণনার কথা প্রভৃতি শোনা যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো মেদিনীপুরে বিভিন্নভাবে মহাভারত ও ভীম সম্পর্কে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত থাকলেও এখাকার ভীমপূজার সঙ্গে মহাভারতের সম্পর্ক সামান্যই। এখানে বরং লৌকিক দেবতা হিসেবেই ভীমের আধিপত্য বিস্তার হয়েছে, পরে কালের বিবর্তনে পৌরাণিক ভীমের স্তুতি ছড়িয়ে পড়েছে। এদিক থেকে মহাভারতের স্বর্ণবর্ণাভ ও তৃবরক ভীমের সঙ্গে মেদিনীপুরের লোকায়ত সমাজে পূজিত ভীমের মুর্তি ও দেহাবয়ব এর পার্থক্যের কথা বলা যায়। পৌরাণিক ভীমের পরিচয় ভীমকে মধ্যম পাণ্ডব রূপে চিহ্নিত করলেও লোকায়ত সমাজে ভীম মুলত চাষী। মেদিনীপুরের লোকসমাজে প্রচলিত বিশ্বাস, মেদিনীপুরের মাটিতেই ভীম প্রথম চাষ করেন এবং ভীমের দ্বারাই কৃষিকর্মের প্রবর্তন হয়। এ সম্পর্কে একটি লৌকিক ছড়া উল্লেখযোগ্য–

“মেদিনীপুরে হালুই ভীম,

ভীম হুড চাষী

তাই – ভীম একাদশী।।”

এখানে স্পষ্টতই কৃষিকর্মের সাথে ভীমের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়, যা ভীম একাদশী বা ভীমপূজার সাথে কৃষিকাজের সম্পৃক্ততার স্বাক্ষর বহন করে। কারণ ভীমপূজার সময় হচ্ছে মাঘ মাস। পৌষ সংক্রান্তির ফসলের পর নবান্ন উৎসবের পর মাঘ মাস বাংলার কৃষককের কাছে নতুন উদ্যমে কৃষিকর্মের প্রস্তুতির কাল। খনার বচনেও দেখা যায়, মাঘের মাটিই কৃষিকর্মের পক্ষে সর্বাধিক মূল্যবান–

“মাঘের মাটি

হীরের কাঠি।”

লোক-প্রচলিত বিভিন্ন কিংবদন্তীর সূত্রে দেখা যায়, ভীমের প্রধান কাজকর্ম এবং লোকাযত সমাজে ভীমের বিশেষ পরিচয়– খেত্তী, চাষী, হালুয়া, কৃষিকর্মের মুনিশ। অবশ্য উচ্চ সমাজের কাছে ভীম শিবের কৃষিকর্মের প্রধান সহায়ক। মেদিনীপুরের কবি রামেশ্বরের শিবায়ম কাব্যের সাক্ষ্যে দেখা যায়, ভীম শিবের কৃষিকর্মের মুনিশ, হাল্যা। কবি রামেশ্বর শিব-সংকীর্তন বা শিবায়ন কাব্যের লৌকিক খণ্ডে দেখা যায়, পার্বতীর পরামর্শে শিব দারিদ্র্য পীড়িত সংসারের অচলাবস্থা দূর করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের কাছ থেকে কৃমিজমির পাট্টা সংগ্রহ করেন, শল ভেঙে ভাল প্রস্তুত করেন এবং কৃষিকর্মের জন্য কৈলাস ত্যাগ করে পৃথিবীতে যান। আর তার সঙ্গে চলেন শিবের কৃষিকর্মের প্রধান সহায়ক প্রধান হাল্যা ভীম–

“ভীম আছে হাল্যা আর অনির্বাহ কি হয় বলে হদ্দ কৈলে হেমন্তের ঝি ॥

চন্দ্রচূড় চলে বুষে চণ্ডীরয় চায়্যা পিছু ভীম চলিল চাষের সজ্জা লয়্যা ॥

এই রূপে প্রতিদিন যায় রাত্রিকাল ভীম করা ভোজন প্রভাতে যুড়ে হাল ॥”

এই কিংবদন্তির সূত্র ধরেই মহাভারতের গদাধারী বীরবিক্রম ভীম কৃষিদেবতা হিসেবে বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন হাজার বছর ধরে।