Friday, October 11, 2024
আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশের সিলেটে জয়ন্তী শক্তিপীঠে দেবী সতীর বাম জঙ্ঘা পতিত হয়েছিল, সেই মন্দিরেরই দেড় একর জমি বেদখল

সংগ্রাম দত্ত: বাংলাদেশের সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার বাউরভাগ গ্রামের অবস্থিত জয়ন্তিয়া শক্তিপীঠ যা জয়ন্তী শক্তিপীঠ নামে পরিচিত।

সতীর ৫১ পীঠের কাহিনী অনুসারে দক্ষের যজ্ঞে মহাদেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞের কুন্ডে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন দেবী সতী। আর তারপরে সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য তে মাতেন স্বয়ং মহাদেব। মহাদেবকে শান্ত করতে না পেরে বিশ্ব সংসার রক্ষা করার একমাত্র উপায় ছিল দেবীর দেহকে খন্ড খন্ড করা।

তাই বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর দেহ খন্ড-বিখন্ড করে দেন। সেই দেহ অংশগুলি বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। যেখানে যেখানে দেবীর এই দেহ অংশ গুলি পড়েছিল সেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে এক একটি সতী পীঠ।

জয়ন্তী শক্তিপীঠের ভৌগোলিক গুরুত্ব এই শক্তিপীঠ অথবা সতী পিঠের মধ্যে জয়ন্তী শক্তিপীঠ হল একটি, যা কিনা মেঘালয় এ অবস্থিত, আর মন্দিরের নাম শ্রী নার্তীয়াং দূর্গা মন্দির। আবার অন্যদিকে অনেকের মত অনুসারে এই শক্তি পীঠ অবস্থিত বাংলাদেশের সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার বাউরভাগ গ্রামে অবস্থিত এই সতীপীঠ। এর অবস্থান নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে, অপরদিকে কিছু শাস্ত্রের মত অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে আলিপুরদুয়ার সংলগ্ন ভুটান পাহাড়ের একটি গুহায় এই পীঠ অবস্থিত হলে বর্ণনা করা হয়েছে।

তবে সতী দেবীর দেহ অংশগুলি পৃথিবীর বুকে পড়া মাত্রই সেগুলি প্রস্তর খন্ডে অথবা পাথর খন্ডে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এই বিশেষ বিশেষ স্থান গুলি পরিণত হয় এক একটি সতী পীঠে। তবে এই জয়ন্তীয়া শক্তি পীঠে দেবীর দাক্ষায়নীর বাম জঙ্ঘা অথবা বাম ঊরু পতিত হয়েছিল।

সকল শক্তি পীঠের মতো এখানেও মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর এখানে দেবী জয়ন্তী রূপে পূজিতা হয়ে থাকেন, আর মহেশ্বর শিবের অবতার রূপ হল ক্রমদীশ্বর। অর্থাৎ বলা যায় এখানে শক্তিরূপে জয়ন্তী বিরাজ করছেন আর ভৈরব হলেন ক্রমদীশ্বর।

জয়ন্তী শক্তিপীঠের ইতিহাসে দেবীর মন্দির বলতে জানা যায় যে, চারকোনা অগভীর গর্তের মধ্যে একটি চৌক পাথরের মধ্যে দেবীর পীঠ স্থান অবস্থিত। অনেকের মত অনুসারে দেবী তাঁর ভৈরব ক্রমদীশ্বরের সাথে এই কুন্ডে বিরাজ করেন। মন্দিরের একেবারে কাছাকাছি আরো একটি কুণ্ড আছে। এখানে জল খুবই অল্প হলেও তা খুবই স্বচ্ছ।

এই জল দিয়ে দেবীর পূজা হয়। মন্দিরের থেকে অল্প দূরে আরও একটি শিবলিঙ্গ দেখা যায়। সেখানকার মন্দির জয়ন্তীর রাজা বানিয়ে ছিলেন। প্রথমদিকে স্বপ্নে আদেশ পেয়ে স্থানীয় আদিবাসী মেয়েরা খড়, বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করেছিলেন মন্দির। সেখানে ভগবান শিবের পূজা করা হতো। পরে রাজা এখানে মন্দির নির্মাণ করে দেন। এখানে দেবীর বাম পায়ের নিম্নাংশ পড়েছিল বলে ধারনা করেন অনেকেই। কিন্তু কাহিনী অনুসারে জানা যায় যে, এখানে সতীর বাম জঙ্ঘা অথবা বাম ঊরু পতিত হয়েছিল।

বাউরভাগ এর মন্দিরটি প্রায় ৫.৯০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। পার্শ্ববর্তী স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতকারী মন্দিরের পুকুরপাড়ের জমি অনেকদিন ধরে কিছু কিছু করে কেটে দখল করে নিচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রায় দেড় একর জমি বেদখল হয়ে আছে মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি দিলীপ কৈরী ও স্থানীয় শিক্ষক বিশ্বজিৎ দেব সবুজ জানিয়েছেন। 

কিছু শাস্ত্র অনুসারে জানা যায় মেঘালয়ের জয়ন্তী পাহাড়ে পড়েছিল। দেবীর বাম ঊরু অথবা বাম জঙ্ঘা, দেবী এখানে জয়ন্তী নামে পরিচিত। আর তিনি এই নামে পূজিতা হয়ে থাকেন সবার কাছে। এখানে দেবীর ভার ধরে রেখেছেন স্বয়ং মহাকাল।

দেবী জয়ন্তীর থেকে এখানে মহাকালের প্রাধান্যটা অনেক বেশি। তন্ত্রের মতে সতীই হলো প্রকৃতি আর সব শক্তি এই প্রকৃতিতে বিরাজমান রয়েছে। আর শিব ছাড়া কোন শক্তিরই অস্তিত্ব নেই । এখানে শক্তির সঙ্গে মিলন হয়েছে অপরূপ প্রকৃতির।

মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গেলে এই শক্তি পীঠে পৌঁছাতে অনেক পথ অতিক্রম করে পৌঁছাতে হয় এই সতীপীঠ জয়ন্তীতে। জয়ন্তীর উত্তরে রয়েছে দার্জিলিং, দক্ষিণে রয়েছে গাঙ্গেয় সমভূমি এর মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা, তোর্সা নদী। এরই অববাহিকায় জয়ন্তী শক্তিপীঠ অবস্থিত।

পাহাড় অঞ্চলের রাস্তা পেরিয়ে ট্রেকিং করে পৌঁছাতে হয় মহাকালের মন্দিরে। খুবই রোমাঞ্চকর এবং অনেকটাই সৌন্দর্যমন্ডিত প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে মন্দিরে পৌঁছানো যায়। তিন হাজার ফুট উঁচুতে জঙ্গল আর পাহাড়ে ঢাকা ভারত ও ভুটান সীমান্তে ভুটানের মহাকাল পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই মহাকাল মন্দিরটি।

এই পাহাড়ের চূড়ায় তিনটি গুহা অবস্থিত রয়েছে। আর এই তিনটি গুহা বেষ্টিত মন্দিরকে একসঙ্গে মহাকাল মন্দির বলা হয়। প্রথম গুহায় রয়েছেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু মহেশ্বর, দ্বিতীয় গুহায় রয়েছেন বাবা ভোলেনাথ ও তৃতীয় গুহায় রয়েছেন মা মহাকালী।

চুনা পাথরের পাহাড়ের উপর এই গুহা প্রকৃতির সৃষ্টি। যা কিনা খুবই অপরূপ আর দৃষ্টিনন্দন। গুহায় চারিদিক থেকে জল বের হয়, গুহার অদ্ভুত প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই মনমুগ্ধকর যা কিনা দেখার মত। এই সমস্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য অনুভব করার সাথে সাথে মায়ের দর্শন করতে প্রতি বছর ছুটে আসেন লক্ষ লক্ষ দার্শনিক ও পূর্নার্থীরা।

গুহার ভিতরে গর্ভ গৃহে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়, বলতে গেলে খুবই বিপদসংকুল জায়গা এই মন্দিরটি। সেখানে সারাক্ষণ প্রদীপ জ্বালানো থাকে, এই প্রকৃতির সৃষ্টির মধ্যেই দেবী জয়ন্তীর অবস্থান। প্রতিবছর শিবরাত্রির সময় এবং মহাকালের মন্দিরে পুজো দিতে প্রচুর ভক্ত ও পূর্ণার্থীদের ঢল নামে।

রাস্তা এতটাই বিপদজনক তা সত্বেও প্রতিবছর এখানে ভক্তদের সমাগম চোখে পড়ার মতো। এই স্থান এতটাই দুর্গম যে, কোনরকম যানবাহন চলে না বললেই চলে। যদি আপনাকে মন্দিরে যেতেই হয়, তাহলে পায়ে হেঁটেই এবং তার সাথে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আপনাকে মন্দিরে পৌঁছাতে হবে।

পাহাড়ের মধ্যে জঙ্গলে ঘেরা পরিবেশ সন্ধ্যার পরে আরো নিস্তব্ধ ও নিঝুম হয়ে যায়। যা কিনা সত্যিই শিহরণ জাগানোর মত পরিবেশ। মহাকালের গুহাতে প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত শিলা ঝুরির মহাকালী বিগ্রহ দেখা যায়। যা দেখে অনেকেই জীবনকে ধন্য বলে মনে করেন।

তবে যাই হোক না কেন, দেবীর দেহ অংশগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেকটাই দুর্গম জায়গায় পতিত হয়েছিল ধারণা করাই যায়। যেখানে আজও পর্যন্ত মন্দির অথবা শক্তি পীঠ গড়ে উঠেছে তবে সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই কম বলাই যায়।

এই শক্তি পীঠে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েই যেতে হয়। যা কিনা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে দুর্গম পথে পাড়ি দিয়ে এই শক্তি পীঠ দর্শন করতে হয়।