Monday, May 13, 2024
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের রাজনগরে শ্রী শ্রী বিষ্ণুপদধাম মন্দিরের ইতিহাস

সংগ্রাম দত্ত: বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার তারাপাশা গ্রামে শ্রী শ্রী বিষ্ণুপদধাম অবস্থিত। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে কয়েকজন সন্ন্যাসী পরশুরাম তীর্থে যাচ্ছিলেন। একদিন ক্লান্ত দেহে মনু গঙ্গায় স্নান করে তাঁরা যখন একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, সেই সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে একজন সন্ন্যাসী এই স্থানে শ্রীবিষ্ণুপদচিহ্ন বিরাজিত আছেন বলে স্বপ্নাদেশ পান এবং অদূরেই একটি পাথরে বিষ্ণুপদচিহ্ন মুদ্রিত আছে বলে নির্দেশ পান। এই সন্ন্যাসী মনুনদীর তীরবর্তী একটি স্থানে শাস্ত্র বর্ণিত বিষ্ণুপদ চিহ্ন খুঁজে পান। তখন তিনি পরশুরামতীর্থে যাওয়ার বাসনা ত্যাগ করে, বিষ্ণুপদচিহ্ন প্রতিষ্ঠা করে, নিত্য পূজার ব্যবস্থা করেন। তারাপাশা গ্রামটি পাঁচগাঁয়ের জমিদার সর্বানন্দ দাশের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত। তাই জমিদার বিষ্ণুপদচিহ্নযুক্ত কৃষ্ণপাথরটি নিজবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু বহু শ্রমিকের সম্মিলিত চেষ্টায় প্রস্তরখন্ডটি সরানো সম্ভব হয়নি। জমিদার সর্বানন্দ দাশ স্বয়ং এসে, বিষ্ণুপদচিহ্ন দর্শন করেন এবং তারাপাশা গ্রামেই মন্দির নির্মাণ করে সেবা পূজার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করেন। শ্রীবিষ্ণুর সেবায়ত রূপে জমিদার ৭ কেদার ভূমি দান করে সমস্ত পূজার দায় দায়িত্ব গ্রহণ করায় সন্ন্যাসীরা চলে যান। তারপর থেকেই পর্যায়ক্রমে অনেক সেবায়েত নিযুক্ত করে দীর্ঘকাল যাবত সেবা কাজ চলতে থাকে।

পরবর্তীকালে জমিদার কালীকিশোর দাস মহাশয়ের সহযোগিতায় আব্দা নিবাসী পঞ্চরাম মিত্র ও কাজীরচক গ্রাম নিবাসী বলরাম দত্তের যৌথ প্রচেষ্টায় বিষ্ণুপদ ধামে একটি ছোট্ট মন্দির ও একটি নাটমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। খনন করা হয় একটি পুকুরও। সেই সময় কৃষ্ণ দাস নামে জনৈক সজ্জন সেবায়েত প্রতিষ্ঠানটিকে সকলের কাছে পরিচিত করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কৃষ্ণ দাসের পর রাধারমন বৈষ্ণব সেবায়েতের দায়িত্ব পালন করেন। ১৩৭৪ বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও জননেতা নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী বিষ্ণুপদাম দর্শন করতে আসেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় স্থানীয় ভক্তজনদের নিয়ে ধামের উন্নয়নে প্রচেষ্টা চলতে থাকে। স্থানীয়ভাবে পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়। আরম্ভ হয় উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। এই ধামে রয়েছে শ্রীশ্রী পিণ্ডদান কুন্ড মন্দির, শ্রী শ্রী তুলসী মন্দির, শ্রী শ্রী শিব মন্দির।

১৩৮৯ বাংলায় ১৭ ফাল্গুন বিশ্বেবরেণ্য বৈষ্ণবচার্য ও দার্শনিক ড: মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মহারাজ গৌড় পরিক্রমা উপলক্ষে বিষ্ণুপদধামে শুভাগমন করেন। তিনি দীর্ঘসময় ধরে বিষ্ণুপদ চিহ্ন পর্যবেক্ষণ করে, 

শাস্ত্রগ্রন্থাদিতে বর্ণিত বিষ্ণুপদ চিহ্নের সঙ্গে অপূর্ব সাদৃশ্য দেখতে পান এবং এটাই যথার্থ বিষ্ণুপদ চিহ্ন বলে ঘোষণা দেন। ১৩৯০ বাংলার জ্যেষ্ঠসংক্রান্তি তারিখে শ্রীনিম্বার্ক আশ্রম, সিলেট থেকে লিখিত 

একপত্রে তিনি বলেন ‘ শ্রীভূমি শ্রীহট্টস্থিত তারাপাশা গ্রামের বিষ্ণুপদ চিহ্ন জয়যুক্ত হোক।’

বিষ্ণুপদধামে আয়োজিত বিশাল জনসভায় ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী বলেন ‘অবিশ্বাসী মন নিয়ে গিয়েছিলাম। ইতিহাস শুনে ও শ্রীপদচিহ্ন সংবলিত প্রস্তরকে প্রত্যক্ষ করে মনে সুদৃঢ বিশ্বাস জন্মে যে ইহাই 

শ্রীভগবানের পদচিহ্ন।’ তিনি আরো বলেন ‘ গয়াতীর্থে শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শনে ও পিন্ডদানে যে ফল হবে এই পদচিহ্ন দর্শন স্পর্শন এবং এখানে পিন্ডদান কার্যেও সেই ফল লাভ হবে।’

শ্রীকৃষ্ণ কৃপা করে মনগঙ্গা তীরে স্বয়ং প্রকাশ হয়েছেন বাস্তব প্রয়োজনেই। গয়াধামে বিষ্ণুপদে পিত্রকার্য করা বাংলাদেশের সকল মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। গরিব হিন্দুর পক্ষেতো নয়ই। তাই গয়াপ্রতীম তারাপাশা ধামে শ্রীবিষ্ণুর এই পদচিহ্নের প্রকাশ তাৎপর্যপূর্ণ। মনু নদী প্রাচীন তীর্থমহিমায় ভাস্মর। ভগবান মনু এখানে তপস্যা করেছিলেন। তাই এই পবিত্র তীর্থ সলিলে পিতৃ তর্পণ পিন্ডদান অতি পবিত্র কৃত্য।

গয়াধামে শঙ্খ -চক্র -গদা -পদ্মাধারী শ্রীবিষ্ণুর বিগ্রহ নেই। শুধু পদচিহ্ন আছে। তারাপাশয় তিনি পূর্ণ মূর্তিতে প্রকাশিত হয়েছেন। এখানে শ্রীবিষ্ণুর বিগ্রহ 

শান্তামুকুল। এই কারণেই এই পবিত্র স্থানে পিতৃকার্য করা উচিত। বায়ুপুরানে উল্লেখ আছে এই পুণ্য সলিলা মনুনদীর কথা। যেখানে শ্রীবিষ্ণুর প্রকাশ হয়েছে। ঊনকোটি তীর্থের মধ্যবর্তী এ স্থান। নানা মনীষীগণও তারাপাশার স্থানমাহাত্ম্য স্বীকার করেন।

এখানে রয়েছে শ্রী শ্রী পিণ্ডদান কুন্ড মন্দির, শ্রী শ্রী তুলসী মন্দির, শ্রী শ্রী শিব মন্দির।

এ পরম তীর্থে স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু তাঁর পদচিহ্ন প্রকাশ করেছেন। এখানে প্রতিদিন পিতৃপিণ্ড দান করার মানসে শত শত পূর্ণ্যার্থীর আগমন হয়। পিতৃপক্ষ পিতৃতর্পণ, পিন্ডদান উৎসব ও গৌড়পূর্ণিমায় ৫ দিনব্যাপী বার্ষিক উৎসব উদযাপিত হয়।