Thursday, May 16, 2024
আন্তর্জাতিকসম্পাদকীয়

সমাজ সংস্কারক ব্যারিষ্টার আনন্দ মোহন বসুর ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশের বিশাল বাড়িটি বেদখল

সংগ্রাম দত্ত: ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু। ভারতবর্ষের প্রথম র‍্যাংলার, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের প্রতিষ্টাতা,একজন বাঙালি রাজনীতিবিদ,ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি,ভারতীয় উপমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তনকারী, তিনবার বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য,নারী জাগরনের অগ্রদুত,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য,ক্যালকাটা স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা,শিক্ষাবিদ,সমাজ সংস্কারক, একজন সমাজসেবক। 

দুঃখজনক হলেও সত্য যে তিনি যে বাড়িটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন সেই ঐতিহ্যবাহী বিশাল বাড়িটি বর্তমানে স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা কর্তক দখল হয়ে আছে বলে জানা গেছে।

১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলা ইটনা থানার জয়সিদ্ধি গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এক সময় পুর্ব পুরুষের পৈতৃক নিবাস ছিল হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানার জলসুখা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম পদ্মলোচন বসু,মাতার নাম উমা কিশোরী নন্দী মজুমদার। ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসুর মা উমাকিশোরী নন্দী মজুমদার হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার আন্দিউড়া গ্রামের বিখ্যাত নন্দী পরিবারের মেয়ে।আনন্দ বসুর মামার নাম হরনাথ মজুমদার।আনন্দমোহন বসুর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ময়মনসিংহে।

১৮৬২ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় ৯ম স্থান অধিকার করে এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। আনন্দমোহন বসু বিয়ে করেন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভগবান চন্দ্র বসুর কন্যা স্বর্ণপ্রভা বসুকে। বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন হলেন স্বর্ণপ্রভা বসু।

১৮৬৪ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।

১৮৬৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। বিএ পরীক্ষায়ই শীর্ষস্থান অধিকার করেন।

 ১৮৭০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত প্রেমচাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ইংল্যান্ড চলে যান। 

১৮৭৪ সালে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে উচ্চতর গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করেন। অনার্সসহ ডিগ্রী পরীক্ষা তথা ট্রাইপস পরীক্ষা প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। প্রথম ভারতীয় র‌্যাংলার বা গণিতবিদ হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ভারতবর্ষের তিনজন র‍্যাংলার ছিলেন। প্রথমজন হলেন ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু, দ্বিতীয়জন হলেন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার কিরন চন্দ্র দে,তৃতীয়জন হলেন নরসিংদী জেলার ভাটপাড়া গ্রামের কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত বা কেজি গুপ্ত।

১৮৭৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিষ্টার পাশ করেন।

১৮৭৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। 

১৮৭৫ সালে ক্যালকাটা স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন প্রতিষ্টা করেন।

১৮৭৬ সালে কলকাতায় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৮৭৮ সালের ১৫ মে ব্রাক্ষ সমাজ প্রতিষ্টা করেন। স্ত্রীসহ ব্রাক্ষ ধর্ম গ্রহন করেন।

১৮৭৯ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর সহযোগিতায় কলকাতায় সিটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । এটি এখন কলকাতা আনন্দমোহন কলেজ। 

১৮৮২ সালে ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিটির সদস্য হন।

১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহ শহরে ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন নামে বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা বর্তমানে আনন্দমোহন কলেজ। 

১৮৮৩ সালে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের একটি জাতীয় সভার আলোচনা সভার আহবান করেন।এই এসোসিয়েশনই ” ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস” এ পরিনত হয়।

১৮৮৪ সালে ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন।

১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্টার অন্যতম সদস্য ছিলেন। 

১৮৯০ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন।

১৮৯২ সালে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় Calcutta University Act of Incorporation সংশোধন করা হয়। যার কারনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গীয় আইন পরিষদে একজন সদস্য নির্বাচন করার অধিকার লাভ করেন।

১৮৯৫ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।

১৮৯৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন।

 ১৯০৬ সালের ২০ আগষ্ট ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরন করেন।

ময়মনসিংহ জেলা শহরের রামবাবু রোড এলাকায় অবস্থিত বর্তমান সিটি কলেজিয়েট স্কুলটি ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসুর পৈতৃক নিবাস।

গত ২৩ শে সেপ্টেম্বর ২০২১ জাতীয় দৈনিক যুগান্তরে “স্মরণীয় কীর্তির বিস্মৃত পুরুষ” শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান লিখেছেন যে আনন্দমোহন বসুর স্মৃতিবিজড়িত তাঁর জন্ম স্থান জয়সিদ্ধিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপত্য-কীর্তির অনন্য নিদর্শন, তাঁর পূর্বসূরিদের বসতবাড়িটি বর্তমানে বেদখল।

জানা গেছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মোহাম্মদ আব্দুল হাই নামের স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা আনন্দমোহন বসুর বিশাল আয়তনের এ বাড়িটিকে দখল করে রেখেছেন।

যুগান্তরের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমান প্রতিবেদনে আরো লিখেছেন যে র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসুর জন্ম ভিটার এখন বেহালদশা। বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি বিখ্যাত এ সমাজ সংস্কারকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি বেদখল হয়ে আছে। ফলে অরক্ষিত জন্মভিটায় অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন বসতবাড়িটি।

কয়েক একর আয়তনের বাড়িটিতে রয়েছে কয়েকটি বিশাল ভবন, খোলা মাঠ ও একাধিক পুকুর। বিশাল বসতবাড়িটি পরিণত হয়েছে পরগাছা উদ্ভিদের বাসস্থানে। চারদিকে নির্মিত প্রতিরক্ষা দেওয়ালের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দেওয়ালের অনেক জায়গার ইট-পাথর দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে। আনন্দমোহন বসুর আঁতুড়ঘরটিকে বানানো হয়েছে গোবরের গর্ত। এ অবস্থায় ঐতিহ্যের নিদর্শন এসব স্থাপনা বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী আনন্দমোহন বসুর জন্ম স্থান ও বসতবাড়ি দেখার জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রায়ই দর্শণার্থীরা আসেন। কিন্তু বসতবাড়িটি বেদখল হয়ে থাকায় বাড়িটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত পর্যায়ে চলে গেছে। এরপরও বসতবাড়িটি উদ্ধার কিংবা সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ বা আগ্রহ নেই প্রশাসন কিংবা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক এ স্থানটিকে সংরক্ষণ করে তাঁর পণ্য স্মৃতি ও স্থাপত্যকীর্তির প্রতি সম্মান জানাবে, এ প্রত্যাশা এলাকাবাসীসহ বসুর ঐতিহ্য।

গত ৩ মে ২০১৮ দেশের স্বনামধন্য ইংরেজি পত্রিকা দি ডেইলি স্টার ঐতিহ্য বাড়িটি সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান এর এক সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, “জয়সিদ্ধি গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে বসুর পূর্বপুরুষ জয়রাম ও সিদ্ধিরাম বসুর নামে। “১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় বোস পরিবারকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। তখনই আমির উদ্দিন জমি দখল করে নেন।

প্রায় আট বছর আগে মারা যাওয়া আমির উদ্দিন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। এই সম্পত্তির বর্তমান দখলদারদের পিতা। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফজলুর বলেন, বর্তমান দখলদারদের পিতা সংলগ্ন আলগাপাড়ার স্বাধীনতাবিরোধী নেতা ছিলেন।

 “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমির স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন বলে ইটনা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নজরুল ইসলাম ঠাকুর ডেইলি স্টারের প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

স্পষ্টভাষী রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমান বলেছেন প্রথমে আমির সম্পত্তিটি ‘লিজ’ নিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় সম্প্রদায় তাকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে তিনি পুনরায় দখলে ফিরে আসেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐতিহ্যবাহী এ বাড়ি থেকে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়েছিল। বোসের গ্রন্থাগারের শত শত বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বাড়ির সামনে দুটি বড় পুকুর ছিল কিন্তু সেগুলি কয়েক বছর ধরে ভরাট হয়ে গেছে।”

সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ বোস সম্পত্তি দখল মুক্ত করে একটি পাবলিক হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করার দাবি জানান। 

আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল একমত হন, “কোনও ইজারা থাকলে তা বাতিল করা উচিত। “বোসের সম্পত্তি দখলমুক্ত করা উচিত। সেই জমি বৃহত্তর ময়মনসিংহের জন্য অমূল্য ঐতিহ্য এবং জনসাধারণের কাজে ব্যবহার করা উচিত। আমরা শীঘ্রই এটি মুক্ত করার জন্য একটি আন্দোলন শুরু করব ।”

 কিশোরগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ আসাদ উল্লাহ একইভাবে সম্পত্তি উদ্ধার করে জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।

 স্থানীয় সংগঠন জাগোরিতো ইটনার আহ্বায়ক কামরুল হাসান খান জুয়েল বলেছেন, “গত বছর বসতবাড়ি ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল।

আমিরের ছেলে এবং জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাই তার বাবা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। “আমার বাবা ১৯৬৭ সালে বোস পরিবারের প্রায় দুই একর জমি লিজ নিয়েছিলেন তিনি বলেছেন। “মুক্তিযুদ্ধের পর ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নবায়ন করা হয়। আমার বাবা স্থানীয় শান্তি কমিটির সাথে জড়িত ছিলেন না। এলাকায় এমন কোনো রিপোর্ট নেই।”

ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মশিউর রহমান খান বলেন, ইজারার বৈধতা নিয়ে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। “যতদূর আমি জানি দুই একর জমি লিজ নেওয়া হয়েছিল, তাই এটি জমি দখল নয়। তিনি বলেছেন “যেহেতু কোনো অভিযোগ করা হয়নি আমার তদন্ত করার সুযোগ নেই।”

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখী রায় বলেন, সম্পত্তি অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত নয়। “আমরা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য শীঘ্রই সাইটে একটি দল পাঠাব। যদি জায়গাটিকে সংরক্ষণের যোগ্যতা বলে মনে করা হয় তবে আমরা সেই অনুযায়ী এগিয়ে যাব।”