Friday, April 26, 2024
সম্পাদকীয়

ষষ্ঠী দেবীর ব্রতকথা

কলকাতা ট্রিবিউন ডেস্ক: প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে জামাই ষষ্ঠী ব্রত পালন করা হয়। জৈষ্ঠ্যমামের শুক্লপক্ষীয় ষষ্ঠীকে অরণ্য ষষ্ঠী, স্কন্দ ষষ্ঠী জামাই ষষ্ঠী প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়। বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষে বিভিন্ন নামে এ ষষ্ঠীপূজা অনুষ্ঠিত হয়।আতপ চালের পিটুলি দিয়ে একটি বিড়াল এঁকে এ ব্রত করা হয় । আম, কাঠাল, লেচুসহ বিবিধ প্রকারের ফলফলাদি দিয়ে নৈবেদ্য সাজাতে হয়। ৬টা পান ও ৬টা সুপারি হলুদে ছোপানো কাপড়ের টুকরো বাঁশ পাতায় জড়িয়ে, ৬ গাছা সুতো পাকিয়ে ও হলুদ মাখিয়ে তার সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। এই সুতোকে ষাট সুতো বলা হয়। চিড়ে, খই, দই, তেল ও হলুদ দিয়ে দেবী ষষ্ঠীর ব্রতপূজা করতে হয়। ষষ্ঠী দেবী বা অরণ্যষষ্ঠী দেবী স্বয়ং আদ্যাশক্তি মহামায়া জগদ্ধাত্রী। তিনি মহাশক্তি মহামায়ার সন্তানপ্রদাত্রী রূপ। বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে দেবীর ধ্যানমন্ত্রেই পাওয়া যায়।

 

দ্বিভুজাং যুবতীং ষষ্ঠীং বরাভয়যুতাং স্মরেৎ।

গৌরবর্ণাং মহাদেবীং নানালংকারভূষিতাম্।।

দিব্যবস্ত্র পরিধানাং বামক্রোড়ে সষুত্রিকাম্ । প্রসন্নবদনাং নিত্যাং জগদ্ধাত্রীং সুতপ্ৰদাম্ ॥

সর্বলক্ষণ সম্পন্নাং পীনোন্নতপয়োধরাম্ ॥

 

“দ্বিভুজা, যুবতী, বর ও অভয়মুদ্রাধারিণী, গৌরবর্ণা, নানা অলংকারে বিভূষিতা, দিব্যবস্ত্রপরিহিতা, বামক্রোড়ে স্থিত পুত্রসহিতা, প্রসন্নবদনা, নিত্যা, জগদ্ধাত্রী, সন্তানদায়িনী, সর্বলক্ষণাযুক্তা, উন্নত পয়োধর বিশিষ্টা ষষ্ঠী দেবীর ধ্যান করি।”

সকলের কপালে কাঁচা হলুদ স্পর্শ করে দেবীর আশীর্বাদসূচক ষাট সুতা ডান হাতে মঙ্গল কামনায় বাঁধতে হয়। ষাট সুতা হাতে বেঁধেই সকলকেই জামাই বা অরণ্য ষষ্ঠীর ব্রতকথা শুনতে হয়। ষষ্ঠী দেবীর পূজার অবিচ্ছেদ্য অংশ হল দেবীর মাহাত্ম্যসূচক ব্রতকথার বর্ণনা বা পাঠ। সাধারণত দেবীর পূজা সমাপনান্তে এ ব্রতকথা পাঠ করতে হয়। সংক্ষেপে ষষ্ঠী দেবীর ব্রতকথাটি হল:

এক ব্রাহ্মণীর তিন ছেলে ছিল। তিন ছেলেই বিবাহিত ছিল। সেই তিন ছেলের বউয়ের মধ্যে ছোটবউয়ের খাবারের প্রতি খুব দুর্বলতা ছিল। ঘরের বিভিন্ন প্রকারের খাবার সে নিজে চুরি করে খেয়ে, সে সকল দোষ বাড়ির পোষা একটি কালো বেড়ালের ওপর দিয়ে দিত। বেড়াল দেবী ষষ্ঠীর বাহন। সে অত্যন্ত দুঃখিত হৃদয়ে দেবী ষষ্ঠী কাছে এই অপবাদের বিচার দিত।

প্রতিদিন পোষ্য বিড়ালের নামে অপবাদ দিতে দিতে ছোট বউয়ের সাহস বেড়ে যায়। সে এই কাজটি নিয়মিত করতেই থাকে। এমনি করে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে অরণ্য ষষ্ঠী ব্রতের দিন এসে গেলো। ব্রাহ্মণী ষষ্ঠীব্রত করবে, বাড়িতে আনন্দ উৎসব শুরু হল। ব্রাহ্মণী ষষ্ঠী দেবীর জন্য নিজের হাতে পায়েস, মিষ্টি, ক্ষীর ও নাড়ু তৈরী করল। ছোটবউকে বলল, বউমা, আমি তো সকালবেলাতেই স্নানটা সেরে মায়ের ভোগের বিবিধ প্রকারের উপাচার তৈরি করেছি, এখন পুনরায় আরেকবার স্নান করে এসে মায়ের পূজা সারবো; তুমি ততক্ষণ এখানে বসে একটু খেয়াল রাখো যেন কালো বেড়ালটা দেবীর জন্য তৈরিকৃত প্রসাদের উপাচারে মুখ না দেয়। পুত্রবধূকে এ নির্দেশনা দিয়ে ব্রাহ্মণী চলে গেলো স্নান সারতে। এদিকে বিবিধ প্রকারের ভালো ভালো খাবার দেখে ছোটবউ আর লোভ সংবরণ করতে পারলো না। সে মিষ্টি, ক্ষীর, পায়েস, দই যা পারলো তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। নিজেই দেবীর প্রসাদ খেয়ে নিয়ে খানিকটা দই তিনি বেড়ালটার মুখে মাখিয়ে দিলেন। এদিকে ব্রাহ্মণী স্নান সেরে এসে দেখলেন যে, দেবীর উদ্দেশ্যে তৈরিকৃত প্রসাদ কে যেন খাবলে খাবলে খেয়ে নিয়ে গেছে। ব্রাহ্মণী ছোটবউকে তখন জিগ্যেস করল, ও বউমা! দেবীর উদ্দেশ্যে তৈরিকৃত প্রসাদ কে এমন করে খাবলে খেয়ে গেল? ছোটবউ তখন বলল, কী জানি মা! একটু অন্যমনস্ক হয়ে ছিলাম সে সময় আমার চোখে ধুলো দিয়ে কালো বেড়ালটা সব খেয়ে নিয়েছে হয়ত। দেখুন না মা, ওর মুখে এখনো দই লেগে আছে। এই পাজি বিড়ালটিই যে সব খেয়েছে এটাই বড় প্রমাণ যে, ওর মুখে দই লেগে আছে। এ বলে ছোটবউ নিরপরাধ বেড়ালটাকে চোর সাজিয়ে বেশ দু’চার ঘা দিয়ে আহত করলো।

ব্রাহ্মণী আবার সব নতুন করে যোগাড় করে পূজার ব্যবস্থা করল। এদিকে কালো বেড়ালটা মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বনে চলে গেল। যেখানে দেবী অরণ্যষষ্ঠী আবির্ভূতা হলেন।বিড়ালটি দেবীর কাছে সকল কথা বলে দিল। বিড়ালের কথা শুনে দেবী ষষ্ঠী বললেন, দুঃখ করিস না, আমি সকলই জানি তুই কাঁদিস না—আমি অতিদ্রুত ছোটবউকে তার কৃতকর্মের প্রতিফল প্রদান করবো।

এভাবে দিন চলে যায়। কিছু মাস পরে ছোটবউয়ের সন্তান সম্ভাবনা দেখা দেয়। দশ মাস দশ দিন পরে সে ফুটফুটে সুন্দর চাঁদের মতন একটি ছেলে প্রসব করল। ব্রাহ্মণী নাতির মুখ দেখে অত্যন্ত খুশি হল।তিনি গরীব দুঃখীদের সাধ্যমত দান করতে লাগলেন। এদিকে ছোটবউ তার ছেলেকে কোলের কাছে নিয়ে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু হায়, সকালবেলা ঘুম ভাঙতে দেখে তার ছেলে তার কোলের কাছে বিছানায় নেই। শাশুড়ী ও বৌসহ সাড়া পরিবার চিন্তিত হয়ে চারিদিকে খোজাখুজি করতে লাগল। কিন্তু সকল স্থানেই খোজাখুজি করার পরেও তার ছেলেকে কোথাও পাওয়া গেল না।একই রকম করে ছোটবউয়ের পর পর সাতটি ছেলে আর একটি মেয়ে হল, কিন্তু প্রত্যেকটি সন্তানই এভাবে রহস্যময়ভাবে হারিয়ে গেল। রাত্রিরে ছোটবউ কোলের কাছে সন্তান নিয়ে শুতো আর সকাল হলেই সেই সন্তানকে আর কোথাও পাওয়া যেত না। এভাবে বেশ কয়েকবছর চলে যাওয়ার পরে পাড়া প্রতিবেশী সকলেই একদিন বলতে শুরু করলো যে, ছোটবউ মানুষ নয় নিশ্চয়ই রাক্ষসী। সদ্যোজাত সন্তানগুলোকে সে নিজেই খেয়ে ফেলছে। এই বউকে কিছুতেই আর বাড়িতে বা এ গ্রামে রাখা উচিত হবে না, ওকে যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত।

এক কান দুইকান করতে করতে পাড়ার লোকের এই সকল কথাগুলো ছোটবউয়ের কানে গেল। সে আর সহ্য করতে পারলো না। এমনিতেই তার কাছে জীবন এবং সংসার অসহ্য হয়ে যাচ্ছিল। সকলের অজান্তে সে নিজেই বাড়ি ছেড়ে একদিন গভীর বনে চলে গেল। সে বনে একাকিনী বিচরণ করতে করতে গিয়ে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে সে সন্তানের রক্ষাকর্ত্রী দেবীর উদ্দেশ্যে বলে- আমার এ কী দশা হল মা ? তুমি আমায় সাত-সাতটি ছেলে আর একটি মেয়ে দিয়েও সব কেড়ে নিলে? কেন মা তুমি এমন নিষ্ঠুর? যখন আমার সকল সদ্যোজাত সন্তানকেই তুমি তলে নিলে, তখন তুমি আমাকেও তোমার কাছে তুলে নিয়ে নাও, আমি আর একদিন দূরে থাক একদণ্ডও বাঁচতে চাই না। গভীর বনে একাকিনী ছোটবউয়ের কান্নায় দেবী ষষ্ঠীর তার প্রতি দয়া হয়। দেবী তখন একটি বুড়িমার রূপ ধরে তার কাছে আসে। সে বুড়িমা রূপী দেবী ষষ্ঠী ছোটবউকে বলে- এই বন-বাদাড়ে, তুমি একলা বসে কাঁদছো কেন মা? ছোটবউ তখন দেবী ষষ্ঠীকে সদ্যোজাত সন্তান হারানোর সকল বৃত্তান্ত খুলে বলে। বুড়িমা রূপী দেবী ষষ্ঠী তখন ক্রুদ্ধ হলে বললেন, ওরে বেটি! আসল কথাগুলো সব লুকিয়ে রাখলি কেন? তুই যে লুকিয়ে লুকিয়ে মাছ, দুধ, পূজোর মিষ্টিসহ বিবিধ উপাচার সব নিজে খেয়ে শাশুড়ীর কাছে কালো বেড়ালটার নামে নিত্য দোষ দিতিস সে কথা ভুলে গেছিস? নিজের দোষ অন্য নিরপরাধের উপরে দিতে তোর লজ্জা হত না, নির্লজ্জ কোথাকার! তোর সেই পাপের কারণেই আজ তোর এই দুর্দশা হয়েছে।বুড়িমার কথা শুনে ছোটবউ ভয়ে আৎকে উঠে। সে বুঝতে পারে এ বুড়িমা কোন সাধারণ কেউ নয়। সে তখন আছড়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে- তুমি কে মা? কেমন করে আমার সব গোপনীয় কথা জানতে পারলে? আমায় দয়া করো, তা না হলে আমি তোমার পা ছাড়বো না। আমি আমার পূর্ববর্তী পাপকর্মের জন্যে অনুতপ্ত। সেই পাপ খণ্ডানোর জন্য তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। ছোটবউয়ের কাতরতা দেখে, অবশেষে দেবী বললেন, শোন বাছা! আমিই দেবী ষষ্ঠী, পৃথিবীর লোক প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে যা করে আমি সকলই জানতে পারি। ছোটবউ তখন আবার কেঁদে বলতে বলে- মা! আমি খুব অন্যায় করেছি, আমার পাপের শেষ নেই, আজ যখন দয়া করে আমায় দেখা দিয়েছো তখন তুমি আমায় এই পাপের হাত থেকে রক্ষা করো। পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। দেবী ষষ্ঠী তখন বললেন, ঐ দেখ পথের ধারে ওইখানে একটা মরা বেড়াল পঁচে পড়ে আছে। যদি এক হাঁড়ি দই ওই বেড়ালটার গায়ে ঢেলে দিয়ে সে দই জিভ দিয়ে চেটে ফের হাড়িতে তুলতে পারিস, তবে তোর পাপের খণ্ডন হবে এবং তুই তোর সন্তানদের পুনরায় ফিরে পাবি।

দেবী কথা শুনে ছোটবউ একদণ্ডও আর অপেক্ষা না করে, এক হাঁড়ি দই এনে সেই পচা বেড়ালটার গায়ে ঢেলে দেয়। পরে জিভ দিয়ে চেটে সমস্ত দই আবার হাঁড়িতে তুলে আনে। দেবী ষষ্ঠীও ছোটবউয়ের কর্মে প্রসন্ন হয়। সে ছোটবউকে তার সকল সন্তান ফিরিয়ে দিয়ে বলে- এই নাও তোমার ছেলে-মেয়ে। এই অমৃত দই দিয়ে সকলের কপালে ফোঁটা দাও, আর এদের নিয়ে। সুখে ঘরসংসার কর। আর কখনও পূজার প্রসাদ লুকিয়ে খেয়ে অন্যের নামে দোষ দিও না। ছেলে-মেয়েদের কখনো দূর হ, মরে যা ইত্যাদি বলবে না। অন্য কাউকে যদি সন্তানের প্রতি এ সকল কুবাক্য বলতে শোন, তবে দেবী ষষ্ঠীকে স্মরণ করে ‘ষাট ষাট’ বলবে। এ সকল কথা বলে দেবী ষষ্ঠী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

ছোটবউ তখন তার সাত ছেলে ও এক মেয়েকে সাথে নিয়ে আনন্দে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসে। শাশুড়ীকে প্রণাম করে সে ষষ্ঠীদেবীর সকল কথা শাশুড়ীকে সে জানায়। সকল কথা শুনে ব্রাহ্মণী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। তার চোখে আনন্দাশ্রু চলে আসে। সে বারংবার দেবী ষষ্ঠীকে স্মরণ করে তাঁর উদ্দেশ্যে প্রণাম করতে থাকে। নাতি-নাতনীকে পেয়ে ব্রাহ্মণীর অত্যন্ত আনন্দ হল। দেখতে দেখতে নাতি-নাতনী বড় হয়ে যায়। তাদের সে বিয়ে করায়।জ্যৈষ্ঠ মাসে শুক্লপক্ষে ষষ্ঠী তিথিতে খুব জাঁক-জমক করে ছোটবউ সন্তানাদি নিয়ে অরণ্যষষ্ঠী ব্রত করে। লোকমুখে অরণ্যষষ্ঠী বা জামাই ষষ্ঠীর ব্রতের মাহাত্ম্যের কথা দেশেদেশে ছড়িয়ে যায়।

 

তথ্য সহায়তা: ১. কালীকিশোর বিদ্যাবিনোদ সংকলিত, ‘মেয়েদের ব্রতকথা’, অক্ষয় লাইব্রেরী, কোলকাতা: পুনর্মুদ্রণ ২০০৮

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়