Monday, May 13, 2024
সম্পাদকীয়

হোলি তথা দোল পূর্ণিমা কি ?

হোলি হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের একটি অন্যতম উৎসব যা সাধারণত ‘হোলিকা’ নামে সুপরিচিত। এই উৎসবের অপর নাম বসন্তোৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হলি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। একে দোল পূর্ণিমাও বলা হয়ে থাকে। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়। এই উৎসবের ইতিহাসও পৌরনিক এবং চমকপ্রদ। যুগ যুগ ধরে হিন্দু সম্প্রদায় পালন এর আসছে হোলি উৎসব। এই হোলি উৎসবে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পালন করে থাকে। পৌরাণিক কাহিনীগুলোর দিকে ফিরে তাকালে এই হলি উৎসবকে ঘিরে দুইটি উল্লেখযোগ্য কাহিনী বের হয়ে আসে। একটি প্রহ্লাদ ও হোলিকার কাহিনী এবং অন্যটি রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী। হোলি মূলত বসন্তের উৎসব হলেও হোলিকে রংয়ের উৎসবও বলা হয়ে থাকে।

প্রহ্লাদ ও হোলিকা কাহিনীঃ কথিত আছে পৌরাণিক রাজা হিরন্যকশিপু একদিন দাবী করে বসলেন যে এখন থেকে তাকে ঈশ্বর হিসেবে অর্চণা বা পুজো করতে হবে। তিনি নিজেকে বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রভু দাবী করেন। কিন্তু বাদ সেধে বসলো তার ছেলে রাজকুমার প্রহ্লাদ। সে মহান বিষ্ণু ছাড়া আর কাউকে ঈশ্বর মানতে নারাজ। রাজা তার ছেলেকে নানাভাবে চেষ্টা করলেন তার সামনে নতজানু করার কিন্তু প্রহ্লাদ তা প্রত্যাখান করে। ফলশ্রুতিতে রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে তার সৈন্য বাহিনীকে নির্দেশ দেয় প্রহ্লাদকে হত্যা করার। এভাবে নানাভাবে রাজা ছেলেকে হত্যার চেষ্টা করে কিন্তু প্রতিবার তার চেষ্টা বিফলে যায়। নিরুপায় হয়ে দুষ্টু রাজা রাজকুমারকে হত্যার উদ্দেশ্যে যজ্ঞের আগুনে নিক্ষেপের জন্য তার বোন হোলিকা ’কে নিযুক্ত করে। হোলিকা প্রতিজ্ঞা করে রাজকুমারকে হত্যার । সে ঈশ্বরের কাছ হতে বর পেয়েছিল এবং সেই বরের প্রেক্ষিতে সে জানতো কখনও আগুনে পুড়বে না। সে প্রহ্লাদকে ধরে অট্র হাসি দিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেয়। প্রহ্লাদ এবারও বিষ্ণুকে ডাক দেয় এবং বিষ্ণু এবারও তাকে বাঁচায়। কিন্তু আগুনে ভস্ম হয়ে যায় হোলিকা, এই থেকেই হোলি কথাটির উৎপত্তি। হোলিকার এই অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কাহিনিই দোলের পূর্বদিনে অনুষ্ঠিত হোলিকাদহন বা চাঁচর উৎসবের সঙ্গে যুক্ত।

রাধা-কৃষ্ণ কাহিনীঃ এটাও বেশ প্রচলিত। হিন্দু অবতার শ্রীকৃষ্ণ একদিন বৃন্দাবনে রাধা এবং তার সখীদের সঙ্গে খেলা করছিলেন। সে সময় হঠাৎ শ্রী রাধা এক বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখী হয়ে লজ্জিত হন। শ্রীকৃষ্ণের মাথায় তখন একটি বুদ্ধি আসে। তিনি রাধার লজ্জা ঢাকতে এবং বিষয়টি তার সখীদের কাছ হতে শ্রী রাধা এবং তার সখীদের সাথে আবীর খেলা শুরু করেন। তাদের সবাইকে আবির দিয়ে রাঙিয়ে দেন। শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধা এবং তার সখীদের এই আবির খেলার স্মরণে হিন্দু সম্প্রদায় এই হোলি উৎসব পালন করে থাকে বলে প্রচলিত আছে।

একথাও বলা হয়, বর্ষ শুরুর আগে দেহ অশুচি থাকলে যমদূত কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই হোলি উৎসব করে রং মেখে দেহকে রাঙিয়ে তোলা হয়। প্রকৃতির বিচিত্র-বর্ণিল রঙের প্রতি একাত্ম হতেই হোলির প্রচলন হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। হোলি উৎসব বিভিন্ন বর্ণের তরল রং একে অপরকে কখনো দূর থেকে ছিটিয়ে দেয়। কখনো আবার কাছে গিয়ে গায়ে-মুখে হাত দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে তরল রং মাখিয়ে দেয়। হোলি উৎসব শুষ্ক রং মাখানো তেমন একটা চোখে পড়ে না। শুধু রং ছিটানোই হোলি উৎসব প্রধান আনন্দ নয়, হোলি উৎসবে বিভিন্ন স্থানে আদি রসাত্মক গানও পরিবেশন করা হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়।

দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে আবির, গুলাল ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মত্ত হয়। শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। দোলের পূর্বদিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়। এই বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা নেড়াপোড়া নামে পরিচিত। উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি বাংলার দোলযাত্রার পরদিন পালিত হয়।

রবীন্দ্রনাথের সুরে হোলির রঙ আমাদের মর্মে লাগুক:-

ওরে গৃহবাসী খোল্‌, দ্বার খোল্‌, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌।।

রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌।।

বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে।

মউমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা
মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল।
দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌।।