Monday, May 6, 2024
সম্পাদকীয়

ঢাকার ছেলে পশ্চিমবঙ্গের তিনবার নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী

সংগ্রাম দত্ত: প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ একজন কিংবদন্তি তুল্য আদর্শবান ভারতীয় বাঙালি রাজনীতিবিদ স্বাধীনতা সংগ্রামী। 

ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার মালিকান্দায় ২৪ শে ডিসেম্বর ১৮৯১ সাথে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। 

 প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের পিতা পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।তিনি এরপর দুই বার নিয়ে মোট তিনবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন।

প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ১৯২১ সালে টাঁকশালের ডেপুটি এসেস মাস্টারের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। বিভিন্ন মেয়াদে মোট আট বছর কারারুদ্ধ ছিলেন তিনি।

 মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অভয় আশ্রম নির্মাণ করেন এবং ঢাকার বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাসের সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সম্পাদক হন। লবন সত্যাগ্রহ, যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহে যোগ দেন।

প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তিনি প্রাথমিক মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষায় বরাবরই সবচে ভালো রেজাল্ট করতেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমেস্ট্রিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সের পরীক্ষায় প্রথম হন। 

কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক রঙের গবেষণার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডক্টরেট’ সম্মানে ভূষিত করে তাকে । বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। এরপর ‘অনুশীলন সমিতি’-তে যোগ দিয়ে বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। 

কিন্তু পরবর্তী সময়ে গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনে যোগ দেন। গান্ধীজি, নেহেরু, প্যাটেল, কৃপালিনী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

দেশভাগের আগের ৭-৮ বছরে অবিভক্ত বাংলায় তিন-তিনজন মুখ্যমন্ত্রী হন, যথাক্রমে শেরেবাংলা এ.কে.ফজলুল হক , মুসলিম লীগের নিজামউদ্দিন ও সোহরাবর্দি। 

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার অবব্যবহিত পরে পশ্চিমবঙ্গের ‘প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন ড. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ। ড. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন—

১। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখতে মহাত্মা গান্ধীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪৭-এর ১৬ অগাষ্ট কলকাতা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা পরিভ্রমণ করেন।

২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর পৈতৃক বাসস্থান জবরদখলকারীদের উৎখাত করে সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়।

৩। সন্ত্রাস, দাঙ্গা, বে-আইনী অস্ত্র ব্যবহার তথা কালোবাজারি ও মজুতদারি প্রতিরোধে কঠোর ‘নিবারক আইন’ প্রচলন করেন।

এর ফলে শুরু হয় ব্যপক ধরপাকড়। ধরা পড়ে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী। এমনকি বড়বাজার-চিৎপুর-পোস্তা অঞ্চলে পুলিশি অভিযানের নেতৃত্ব দেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ড. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ। 

দেখা যায়, তেঁতুলের বীচি মেশিনে গুড়ো করে আটার সঙ্গে মেশানো হচ্ছে। এমন অনেক জাল-জুয়াচুরির খবর সামনে আসে। এমনকি তাঁর মন্ত্রিসভার জনৈক সদস্য দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে জেনে তার বিরুদ্ধেও তিনি তদন্তের নির্দেশ দেন।

 ফলে দলের ভেতরে ও বাইরের স্বর্থান্বেষীমহল তাঁর বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের কাছে দলীয় নেতারা বিভিন্ন কৌশলে তাঁর অপসারণ দাবী করেন। 

একইভাবে ভারতের অন্যতম বিখ্যাত শিল্পপতি বিড়লার নেতৃত্বে কলকাতার ব্যবসায়ী মহলের একাংশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রফুল্লবাবুর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। 

নেহেরুজি প্রফুল্লবাবুকে খুবই পছন্দ করতেন। কিন্তু সর্দার প্যাটেল তাঁর বিরোধী বলেই পরিচিত ছিলেন। প্যাটেল ইতিপূর্বে একটা অঘটন ঘটিয়েছিলেন। 

প্রফুল্ল ঘোষ মন্ত্রিসভায় দু-জন মারোয়াড়িকে জায়গা দেওয়ার সুপারিশ করেন। নেপথ্যে ছিলেন স্বয়ং বিড়লা। কিন্তু প্রফুল্লবাবু দোষীদের মন্ত্রী সভায় মোটেও ঠাই দেননি। 

ওই দু-জনই আসলে বিড়লার সুপারিশে মন্ত্রী হবেন তা প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু প্রফুল্লবাবু রাজী না হওয়ায় প্যাটেল নেহেরুজীর কাছে অভিযোগ করেন। নেহেরুজী তাতে কর্ণপাত না করায় বিড়লা যান গান্ধীজির কাছে।

 গান্ধীজি এতশত জানতেন না। বিড়লা সুপারিশ করতে বলায় তিনি প্রফুল্লবাবুকে চিঠি লিখে পরামর্শ দেন যে, বদরীদাস গোয়েঙ্কা বা দেবীপ্রসাদ খৈতানকে মন্ত্রী করা হোক।

প্রফুল্লবাবু তখন প্রফুল্লচন্দ্র সেন-কে (পরবর্তীকালে মুখ্যমন্ত্রী) জিজ্ঞেস করেন, কী করবেন, কারণ গান্ধীজিকে আগেই মন্ত্রিসভার তালিকা দেখানো হয়েছিল। তখন তো তিনি কিছু জানাননি।

 প্রফুল্ল সেন বললেন, মহাত্মাজী যখন বলেছেন তাহলে বদরীদাস গোয়েঙ্কাকে নিয়ে নাও। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ড. প্রফুল্ল ঘোষের মন সায় দিল না। তখন গান্ধীজি কানে ভাল শুনতে পেতেন না। ড. ঘোষ আচার্য কৃপালনীকে সব জানালেন। 

কৃপালনীর কাছ থেকে সব কিছু জানার পর গান্ধীজি বলেন, ‘প্রফুল্ল যদি প্রস্তাব সঙ্গত মনে না করে তবে সে যেন ধরে নেয় আমি তাকে চিঠি লিখিনি।’ মারোয়াড়ি বলে কারুর প্রতি কোনও বিদ্বেষ ড. ঘোষের ছিল না।

 তাহলে ঈশ্বরদাস জালানকে বিধানসভার স্পীকার মনে নিতেন না। কিন্তু তাঁর সম্মানবোধে আঘাত লেগেছিল এইভেবে যে বিত্তশালী শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লা নেপথ্যে কলকাঠি নেড়ে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ঠিক করবেন। তাই তিনি রাজী হন নি।

এরপর জি.ডি বিড়লা বাংলার কংগ্রেস নেতাদের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করেন যে, ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে কংগ্রেসের অর্ধেকেরও ৩/৪জন বেশী বিধায়ক ড. ঘোষের পরিবর্তে ডা. বিধানচন্দ্র রায়কে মুখ্যমন্ত্রী করার লিখিত সিদ্ধান্ত নেয়। 

ড. ঘোষ ১৯৪৮ সালের ১৪ জানুয়ারি পদত্যাগ করেন। ২১ জানুয়ারি ডা. রায় কংগ্রেস পরিষদীয় নেতা নির্বাচিত হন। এই আপোষহীন সংগ্রামী নেতা পরবর্তী সময়ে আরও দু-দুবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন। 

ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ প্রথমবার তিনি ১৯৪৭-এর ১৪ আগাস্টে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন। দ্বিতীয়বার ১৯৬৭-সালে দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হন এবং শেষবার ১৯৭১-র তিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। 

ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ এর মত সৎ, আদর্শনিষ্ঠ, নমস্য ব্যক্তিত্ব আজকের উপমহাদেশের রাজনীতিতে মেলা ভার।

ভারতীয় রাজনীতির কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ এর জন্মদিন আজকের এই দিনে উনাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।