Monday, April 29, 2024
সম্পাদকীয়

মনুসংহিতায় নারী অধিকার

কলকাতা ট্রিবিউন ডেস্ক: মনুসংহিতা সকল স্মৃতিশাস্ত্রের অগ্রগণ্য। মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ে নারী এবং পুরুষের উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, নারীপুরুষ একে অন্যের পরিপূরক।একজন ছাড়া, অন্যজন অসম্পূর্ণ। সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর নিজের দেহকে দ্বিধা বিভক্ত করে অৰ্দ্ধেক অংশে পুরুষ ও অর্দ্ধেক অংশে নারী সৃষ্টি করলেন।

দ্বিধা কৃত্বাত্মনো দেহমৰ্দ্ধেন পুরুষোংভবৎ।
অর্দ্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্রভু।৷
(মনুসংহিতা:১.৩২)

“সেই প্রভু প্রজাপতি আপনার দেহকে দ্বিধা করে অৰ্দ্ধেক অংশে পুরুষ ও অর্দ্ধেক অংশে নারী সৃষ্টি করলেন এবং তারপর সেই নারীর গর্ভে বিরাট্‌কে উৎপাদন করলেন।”

মনুসংহিতার নারী-পুরুষের সাম্যাবস্থার বিষয়টি কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাতেও পাওয়া যায়। তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত ‘নারী’ কবিতার প্রথম স্তবকেই বলা হয়েছে :

“সাম্যের গান গাই—
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী!”

মনুসংহিতায় নারী প্রসঙ্গ উঠলে সবার প্রথমেই কিছু আধুনিক নারীবাদী, বামপন্থী এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিগণ মনুসংহিতার নবম অধ্যায়ের একটি বিখ্যাত শ্লোককে (৯.৩) দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, মহর্ষি মনু অত্যন্ত নারী বিরোধী ছিলেন। গবেষণার নামে তারা মনুসংহিতায় বর্ণিত শ্লোকগুলার পৌর্বাপর্য বা সময়কাল বিবেচনায় না নিয়েই তাদের নিজস্ব মতামত এবং সিদ্ধান্ত স্থাপন করেন। কিন্তু ভাল করে একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায় তাদের সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব চিন্তা, নিজস্ব বিশ্বাস, নিজস্ব দর্শন এবং নিজস্ব বাস্তবতার নিরিখে একটি একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত। এ একপাক্ষিক সিদ্ধান্তটিগুলোই গবেষণার নামে চলে আসছে বহুদিন ধরে। নবম অধ্যায়ের শ্লোকটিতে ভাল করে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, শ্লোকে ‘রক্ষতি’ শব্দের সুস্পষ্ট ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ নারীকে পরাধীনতার নাগপাশে বদ্ধ নয় তাকে সকল অবস্থাতেই রক্ষা করতে হবে। গৃহের লক্ষ্মী স্বরূপা নারী যেন কোন অবস্থাতেই দুর্দশাগ্রস্ত না হয়।সনাতন ধর্ম নারীর সম্ভ্রম রক্ষার শিক্ষা দেয়। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সম্ভ্রম রক্ষা করেছিলেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গের সাথে সাথে স্বধর্মদ্বেষী কিছু আত্মঘাতী বুদ্ধিজীবীগণ মহর্ষী মনুর লিখিত মনুস্মৃতিকে নারী বিদ্বেষী গ্রন্থ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রচেষ্টা করে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক।‘মনু’ শব্দ থেকেই মানব, মানবতা, মানুষ, মনুষ্যত্ব ইত্যাদি শব্দের উৎপত্তি। তাই মহর্ষী মনুর নির্দেশনায় শুধু নারী-পুরুষ নয়; বৈশ্বিক মানবতার কথা বলা হয়েছে। শ্লোকগুলাকে স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনা না করে নিজস্ব চশমা দিয়ে দেখতে গিয়ে আমরা মনুসংহিতা নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছি। মানবসমাজের প্রাণ হচ্ছে নারী। তাদের মাধ্যমেই মানব প্রজাতির বংশধারা, প্রজন্ম রক্ষিত হয়। তাই তারা অত্যন্ত সম্মান প্রাপ্য। এ বিষয়গুলো অত্যন্ত সুন্দর এবং সুস্পষ্টভাবে মহর্ষি মনু মনুসংহিতায় বলেছেন।

১.সর্বাবস্থায় নারীকে রক্ষা করতে হবে:

পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষত্তি স্থবিরে পুত্ৰা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমহতি।।
(মনুসংহিতা:৯.৩)

“বিবাহের আগে কুমারী অবস্থায় স্ত্রীলােককে পিতা রক্ষা করবে, যৌবনকালে বিবাহিতা স্ত্রীকে স্বামী রক্ষা করবে, আর বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রেরা রক্ষা করবে; পতি-পুত্রবিহীনা স্ত্রীকেও সন্নিহিত পিতা প্রভৃতিরা রক্ষা করবে।কোনও অবস্থাতেই স্ত্রীলােককে অরক্ষিত স্বাতন্ত্র্য অবস্থায় রাখবে না।

২. গৃহে গর্ভবতী নারীকে আগে খাবার দিতে হবে:

ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে অতিথিকে দেবতা বলে সম্বোধন করা হয়। বেদের তৈত্তিরীয় উপনিষদের সমাবর্তন ভাষণে বলা হয়েছে,”অতিথিদেবো ভব”। তাই কোন গৃহে আগমন করা অতিথি স্বরূপ দেবতাদের গৃহের গৃহকর্তাদের ভোজনের পূর্বেই ভোজন করানো হয়। যেহেতু গৃহে অতিথিকে আগে খাইয়ে পরে গৃহস্থদের খাবার গ্রহণের রীতি। কিন্তু সেই গৃহে যদি কোন নববিবাহিতা বধূ, কন্যা এবং গর্ভবতী নারী থাকে তবে অতিথি ভোজনের পূর্বেই তাদের আগে ভোজন প্রদান করতে হবে। নববিবাহিতা বধূ যেহেতু পিতৃগৃহ থেকে এসে শশুরের গৃহে এক নতুন পরিবেশে আগমন করে। তাই সে নতুন পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে উঠতেও কিছু সময়ের প্রয়োজন। নববিবাহিতা বধূ অধিকাংশ সময়েই নিজের মনের কথা শ্বশুরবাড়িতে মুখ ফুঁটে বলতে লজ্জা পায়। খিদে পেলেও সে লজ্জায় কাউকে বলতে পারে না।তাই পরিবারের সকলের খাবার পূর্বে তাকে কোনরকম বাদবিচার না করেই ভােজন করাতে হবে।গৃহের বালক বালিকাদেরও স্বাস্থ্যের প্রয়ােজনে তাদের দেহে যেন পুষ্টির ব্যাঘাত ঘটতে না পারে তাই সকলে পূর্বেই ভোজন করাতে নির্দেশনা দিয়েছেন মহর্ষি মনু। বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক, বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী।

সুবাসিনীঃ কুমারাংশ্চ রােগিণাে গর্ভিণীস্তথা।
অতিথিভ্যোঽগ্র এবৈতান্ ভােজয়েদবিচারয়ন।। (মনুসংহিতা: ৩.১১৪)

“সুবাসিনী অর্থাৎ নববিবাহিতা বধূ, পুত্রবধূ ও কন্যা, বালক, রােগী এবং গর্ভবতী নারী এদের অতিথি ভােজনের আগেই কোনরকম বিচার না করেই ভােজন করাবে। কারণ, স্বাস্থ্যের প্রয়ােজনে এদের আহারাদির ব্যবস্থায় বিলম্ব হওয়া উচিত নয়। বিলম্ব হলে তাদের পুষ্টির ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই অতিথিভােজনের আগেই এদের ভােজন করালে কোনও দোষ হয় না।”

৩.নারী অপহরণকারীদের মৃত্যুদণ্ড:

নারী অপহরণকারীদের মৃত্যুদণ্ডের মত সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। এ আইনটি আজ পৃথিবীর বহু দেশেই অনুসৃত হচ্ছে।

পুরুষাণাং কুলীনানাং নারীণাঞ্চ বিশেষতঃ।
মুখ্যানাঞ্চৈব রত্নানাং হরণে বধমর্হতি।।
(মনুসংহিতা:৮.৩২৩)

“পুরুষ কিংবা রূপ, গুণ ও সৌভাগ্যসম্পন্না নারী এবং হীরা, বৈদূর্য প্রভৃতি উৎকৃষ্টজাতীয় রত্ন অপহরণ করলে বধদণ্ড হবে।”

৪.পরিবারে পুত্র এবং কন্যার অধিকার সমান:
কন্যা পুত্রের সমান অধিকার ভোগ করবে। কন্যার উপস্থিতিতে কেউ অন্যায়ভাবে তার অধিকার হরণ করতে পারবে না।

যথৈবাত্মা তথা পুত্রঃ পুত্রেণ দুহিতা সমা।
তস্যামাত্মনি তিষ্ঠন্ত্যাং কথমন্যো ধনং হরেৎ।।
(মনুসংহিতা:৯.১৩০)

“কোন ব্যক্তি নিজেও যেমন পুত্রও সেইরকম, অর্থাৎ আত্মা ও পুত্রতে কোন প্রভেদ নেই। আবার দুহিতা বা কন্যার পুত্রেরই সমান অধিকার। কন্যার পুত্র স্বয়ং বিদ্যমান থাকতে অন্য কোনও ব্যক্তি কিভাবে তার পিতার ধন গ্রহণ করবে?”

৫. পতি-পত্নীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য এবং আমৃত্যু:

পতি ও পত্নী অন্যকোন জীবনসঙ্গী গ্রহণ না করে আমৃত্যু একসাথে থাকবে এবং তারা কেউ ব্যাভিচারে লিপ্ত হতে পারবে না। স্ত্রী স্বামীর সাথে যুক্ত হয়ে সর্বদা ধর্মাচরণ করবেন।তাই স্ত্রীকে শাস্ত্রে সহধর্মিণী বলা হয়। সনাতন শাস্ত্রে স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক বিচ্ছেদকে নিন্দনীয় কর্ম বলা হয়েছে।কারণ এতে বংশের সাথে সাথে সন্তানদের মনোজগতে প্রভূত ক্ষতি হয়।

অন্যোন্যস্যাব্যভিচারাে ভবেদামরণান্তিকঃ।
এষ ধর্মঃ সমাসেন জ্ঞেয়ঃ স্ত্রীপুংসয়ােঃ পরঃ।।
তথা নিত্যং যতেয়াতাং স্ত্রীপুংসৌ তু কৃতক্রিয়ৌ।
যথা নাতিচরেতাং তৌ বিযুক্তাবিতরেতরম্।।
(মনুসংহিতা:৯.১০১-২)

“স্ত্রী এবং পুরুষের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য সম্বন্ধে এই কথাই সংক্ষেপে বলা যায় যে, মরণকাল পর্যন্ত পতি-পত্নী পরস্পর পরস্পরের প্রতি ব্যভিচার অর্থাৎ ব্যতিক্রম করবে না।
স্ত্রী এবং পুরুষ বিবাহ-সংস্কারে আবদ্ধ হয়ে সকল সময় এমন কাজ করতে থাকবে, যাতে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে ধর্মাদি কাজ পৃথকভাবে না করে।”

৬. ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড :

জোরপূর্বক নারীদের সাথে অবৈধ যৌন মিলনকে ব্যভিচার বলা হয়। যারা নারীদের ধর্ষণ করে বা উত্ত্যক্ত করে বা তাদের ব্যাভিচারে প্ররোচিত করে তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে তা অন্যদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে এবং কেউ তা করতে আর সাহস না পায়।ধর্ষণ বা নারীদের জোরপূর্বক যৌন মিলনের প্রচেষ্টারূপ ব্যভিচার উৎপন্ন হলে সেক্ষেত্রে করণীয় প্রসঙ্গে মনুস্মৃতিতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেয়া আছে।যারা নারীদের ধর্ষণ করে বা উত্ত্যক্ত করে বা তাদের ব্যাভিচারে প্ররোচিত করে, তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে তা অন্যদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে এবং কেউ তা করতে আর সাহস না পায়।

পরদারাভিমর্ষেষু প্রবৃত্তান্ নৃন্ মহীপতিঃ।
উদ্বেজনকরৈর্দণ্ডৈশ্চিহ্নয়িত্বা প্রবাসয়েৎ।।
(মনুসংহিতা:৮.৩৫২)

“যারা পরস্ত্রী নারীদের জোরপূর্বক যৌন মিলনের প্রচেষ্টা করে ব্যভিচারে রত হয়, রাজা তাদের নাক-কান ছেদন করে এমন শাস্তি দিবেন; যা দেখে সকলে ভীত হয়। সে অবস্থায় তাদের দেশ হতে বিতারিত করতে হবে।”

যোঽকামাং দূষয়েৎ কন্যাং স সদ্যো বধমর্হতি।
সকামাং দূষয়ংস্তুল্যো ন বধং প্রাপ্নুয়ান্নরঃ।।
(মনুসংহিতা:৮.৩৬৪)

“যে পাপিষ্ঠ পুরুষ কোন কন্যাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে, তার কন্যাত্ব ভ্রষ্ট করবে; প্রমাণ পাওয়ার সাথেসাথেই রাজা তাকে সে দিনই বধদণ্ড প্রদান করবেন।তবে কন্যাটির যদি সেই কাজে ইচ্ছা এবং সম্মতি থাকে, তাহলে সম্ভোগকারীর শারীরিক দণ্ড হবে না।”

৭.নারী পূজ্যা, সমাদরনীয়া, ভূষনীয়া, সম্মাণীয়া ও বংশের শ্রীবৃদ্ধির কারণ:

যে বংশে স্ত্রীলোকেরা সন্তুষ্ট থাকে, সেই বংশ নিশ্চিতভাবেই শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে এবং দেবতারাও সেই বংশের প্রতি প্রসন্ন হয়। কিন্তু ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধূ প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা যে বংশে অনাদৃত, অপমানিত সেই বংশ বিষপান করা ব্যক্তির ন্যায় ধন-পশু প্রভৃতিসহ সর্বতোভাবে বিনাশপ্রাপ্ত হয়।দেবতারাও সেই বংশের প্রতি রুষ্ট হন।

পিতৃভির্ভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দেবরৈস্তথা।
পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণমীপ্সুভিঃ।।
যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।
শোচন্তি জাময়ো যত্র বিনশ্যন্ত্যাশু তৎ কুলম্।
ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্দ্ধতে তদ্ধি সর্বদা।।
জাময়ো যানি গেহানি শপন্ত্যপ্রতিপূজিতাঃ।।
তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যন্তি সমন্ততঃ।।
তস্মাদেতাঃ সদা পূজ্যা ভূষণাচ্ছাদনাশনৈঃ।
ভূতিকামৈর্নরৈর্নিত্যং সত্কারেষূৎসবেষু চ।।
(মনুসংহিতা:৩.৫৫-৫৯)

“বিবাহসময়ে পতিই কেবল কন্যাকে ধনাদি দিবেন এমন নয়, বিবাহোত্তর কালেও পিতা, ভ্রাতা, পতি, দেবর ইহারা সকলেই যদি বহুকল্যাণরাশির অভিলাষী হয়, তবে ঐ কন্যাদিগকে ভোজনাদির দ্বারা পূজা করবে ও বস্ত্র অলঙ্কারাদির দ্বারা ভূষিত করবে।
যে বংশে নারীরা বস্ত্রালঙ্করাদি দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হন, সেখানে দেবগণ প্রসন্ন হয়ে থাকেন এবং দেবতারা প্রসন্ন হলে পরিবারের সবাই অভীষ্ট ফল প্রাপ্ত হয়। অন্যথা যে বংশে নারীরা সমাদরনীয় নয়, সে গৃহে যাগ,হোম, দেব আরাধনাদি সমস্ত ক্রিয়াই নিষ্ফল হয়ে যায়।

যে বংশে ভগিনী ও গৃহস্থের সপিণ্ড স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূ প্রভৃতি নারীরা ভূষণ-আচ্ছাদন-অন্নাদির অভাবে দুঃখিনী হয়, সেই বংশ অতিশীঘ্র ধ্বংস প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ দৈব ও রাজাদের দ্বারা পীড়িত হয়।পক্ষান্তরে যে বংশে নারীরা ভোজন-আচ্ছাদনাদিতে দুঃখী না থেকে সন্তুষ্ট থাকে সেই বংশের নিশ্চিতভাবে শ্রীবৃদ্ধি হয়।

ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধু প্রভৃতি স্ত্রীরা অনাদৃত হয়ে যে বংশকে উদ্দেশ্য করে অভিশাপ দেন, সেই বংশ অভিচার হতের মত ধনপশু প্রভৃতির সহিত সর্বতোভাবে বিনাশ প্রাপ্ত হয়।

অতএব যারা ভূতি অর্থাৎ ঐশ্বর্য্য সম্পদাদি কামনা করেন, এইরকম পতিসম্বন্ধীয় লোকেরা উপনয়ন, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি বিভিন্ন সৎকার্য্যানুষ্ঠানে এবং নানা উৎসবে অলঙ্কার, বস্ত্র ও ভোজনাদির দ্বারা নিত্য নারীদের পূজা করবে; অর্থাৎ সম্মানিত করবে।”

৮.স্বামী-স্ত্রীর কেউ ব্যভিচার করতে পারবে না:

স্ত্রিয়ান্তু রোচমানায়াং সর্বং তদ্রোচতে কুলম্।
তস্যান্ত্বরাচমানায়াং সর্বমেব ন রোচতে।।
(মনুসংহিতা:৩.৬২)

” ভূষণাদির দ্বারা স্ত্রী সুসজ্জিত থাকলে সম্পূর্ণ বংশ শোভামণ্ডিত থাকে। আর স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যদি রুচি না থাকে তাহলে সমস্ত পরিবার শোভাহীন হয়ে পড়ে।”
স্বামীর যেমন স্ত্রীর প্রতি সম্পূর্ণ রূচি এবং ভালোবাসা থাকতে হবে। তেমনি বিপরীতক্রমে স্ত্রীর স্বামীর প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পণ এবং ভালোবাসা থাকতে হবে। স্ত্রীকে কায়মনােবাক্যে সংযত থাকতে হবে। পতির এবং তার বংশের কোনও অনিষ্ট চিন্তা করতে পারবে না। তবেই সেই স্ত্রী স্বামীর অর্জিত পুণ্যে লাভ করে এবং সমাজ তাকে ‘সাধ্বী’ বলে প্রশংসা করেন।কিন্তু যে স্ত্রী স্বামীর প্রতি ব্যভিচারিণী হয়ে অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক করে। বিষয়টি জানাজানি হলে জগতে সে যেমন নিন্দনীয় হয় এবং ভয়ংকর রােগের দ্বারা আক্রান্ত হয়।মৃত্যুর পরে মুক্তিলাভ না করে জন্মান্তরে শৃগাল সহ বিবিধ পশুযােনিতে জন্মগ্রহণ করে।

পতিং যা নাতিচরতি মনােবাগদেহসংযতা।
সা ভর্তৃলােকানাপ্লোতি সম্ভিঃ সাধ্বীতি চোচ্যতে।।
ব্যভিচারাত্ত্ব ভর্তুঃ স্ত্রী লােকে প্রাপ্নোতি নিন্দ্যতাম্।
শৃগালযােনিঞ্চাপ্নোতি পাপরােগৈশ্চ পীড্যতে।।
(মনুসংহিতা:৯.২৯-৩০)

“যে কায়মনােবাক্যে সংযত থেকে পতির কোনও অনিষ্ট চিন্তা করে না, সেই স্ত্রী স্বামীর পুণ্যে অর্জিত যে উৎকৃষ্ট লােক, সেখানে গমন করে এবং সাধুগণও তাকে ‘সাধ্বী’ বলে প্রশংসা করেন।

কিন্তু যে স্ত্রী স্বামীর প্রতি ব্যভিচারিণী হয় অর্থাৎ অন্য পুরুষের সাথে সম্ভোগ করে, ইহলােকে সে নিন্দনীয় হয় এবং জন্মান্তরে শৃগাল-যােনিতে জন্মগ্রহণ করে ও নানারকম ক্ষতিকারক রােগের দ্বারা আক্রান্ত হয়।”

৯. মাতা, স্ত্রী এবং কন্যার নামে মিথ্যা দোষারোপ করলে, তাকে দণ্ডিত করতে হবে:

যদি কেউ মা, স্ত্রী বা কন্যার নামে মিথ্যে দোষারোপ করে তাদের নামে কুৎসা রটনা করে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা করে তবে সেই ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করতে হবে। যাতে পরবর্তীতে কেউ এমন ঘৃণ্য কাজ না করে।

মাতরং পিতরং জায়াং ভ্রাতরং তনয়ং গুরুম্।
আক্ষারয়ন্ শতং দাপ্যঃ পন্থানং চাদদদ্ গুরােঃ।।
(মনুসংহিতা:৮.২৭৫)

“মাতা, পিতা, স্ত্রী, ভ্রাতা, পুত্র এবং গুরু এঁদের সম্বন্ধে মিথ্যা দোষারোপ বা নিন্দা করলে এবং শিক্ষাদাতা গুরুকে অহংকারী হয়ে পথ ছেড়ে না দিলে একশ পণ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।”

১০.মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানকে পরিত্যাগ দণ্ডনীয় অপরাধ:

ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া যে ব্যক্তি মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান পরিত্যাগ করে তাকে কঠিন দণ্ড প্রদান করতে হবে।

ন মাতা ন পিতা ন স্ত্রী ন পুত্রস্ত্যাগমর্হতি।
ত্যজন্নপতিতানেতান্ রাজ্ঞা দণ্ড্যঃ শতানি ষট্।।
(মনুসংহিতা: ৮.৩৮৯)

“মা, বাবা, স্ত্রী এবং পুত্র – এদের অকারণে পরিত্যাগ করা চলবে না। এদের কাউকে ত্যাগ করা হয়েছে, এমন হলে ত্যাগকারী ব্যক্তিকে রাজা ছয়শত পণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করবেন।

১১. রাস্তায় নারীকে আগে পথ ছেড়ে দিতে হবে।

বর্তমানে আমরা দেখি নারীদের জন্যে বাস ট্রেন সহ বিবিধ যানবাহনে সংরক্ষিত আসন থাকে। আমরা কোন সিট হলে পার্শ্ববর্তী কোন নারী দাড়িয়ে থাকলে তাকে আগে বসতে দেই। এই অত্যন্ত জনপ্রিয় মানবিক বিধানটি নিরাপদে নারীদের রাস্তায় চলাচল করার ক্ষেত্রে মনুসংহিতায় সুস্পষ্টভাবে দেখি। সেখানে বলা হয়েছে, কোন যানবাহনে বৃদ্ধ মানুষ, অসুস্থ ব্যাক্তি, বোঝা বহনকারী, বিবাহের বর, রাজা, ছাত্র এবং নারীকে আগে পথ ছেড়ে দিতে হবে।

চক্রিণাে দশমীস্থস্য রােগিণাে ভারিণঃ স্ত্রিয়াঃ।
স্নাতকস্য চ রাজ্শ্চ পন্থা দেয়ো বরস্য চ।।
(মনুসংহিতা:২.১৩৮)

“চাকাযুক্তরথাদি প্রভৃতি যানে আরূঢ় ব্যক্তি, বয়স্ক ব্যক্তি, রােগার্ত, ভারবহনে ক্লান্ত ব্যক্তি, স্ত্রীলােক, স্নাতক অর্থাৎ গুরুগৃহ থেকে শিক্ষা সমাপন করা ছাত্র, রাজা এবং বিবাহের উদ্দেশ্যে প্রস্থিত বর এদের আগে যেতে পথ ছেড়ে দেয়া কর্তব্য।”

১২. নারী সৌভাগ্যবর্তী, বহুসম্মানের অধিকারী এবং তারাই গৃহের দীপ্তি :

মাতৃরূপে, কন্যারূপে, স্ত্রীরূপে, ভগ্নীরূপে কিংবা ধর্মকর্মে অংশীদাররূপে নারীই সকল কল্যাণের অন্যতম উৎস। কারণ তারা নতুন প্রজন্ম বা বংশের উত্তরসূরির জন্ম দেয় এবং সেই উত্তরসূরিদের লালন-পালন করে। তারা সংসারে সৌভাগ্য ও আশীর্বাদ বয়ে আনে। তাই তারা প্রতিটি গৃহের লক্ষ্মী স্বরূপা শ্রী। সনাতন ধর্ম নারীর ক্ষমতায়ন সামাজিক ন্যায্যতা এবং সমানাধিকার সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত। বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, অষ্টাদশ পুরাণ সহ শাস্ত্রে বিভিন্ন স্থানেই নারীদের অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে নারীদের রথ বা যানবাহন চালানোর অধিকারও ছিল। সম্মুখ যুদ্ধের অধিকারও ছিল। বাড়ীতে স্ত্রী এবং শ্রী এ দুইয়ের মধ্যে কোনও ভেদ নেই, অভেদ। সন্তানাদি প্রসব ও পালন করে বলে, শাস্ত্রে নারীদের অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী বলা হয়েছে। তারা গৃহের দীপ্তি বা প্রকাশস্বরূপ। বিভিন্ন সৎকার্যের অনুষ্ঠানে এবং নানা উৎসবে উত্তম অলঙ্কার, বস্ত্র ও ভোজনাদি দ্বারা নারীদের সম্মান প্রদর্শন করে সন্তুষ্টচিত্ত রাখতে শাস্ত্রে নির্দেশনা দেয়া আছে। তাই পরিবারের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য নারীকে সর্বদা সুখী রাখতে হবে।কারণ তারাই জগন্মাতা আদ্যাশক্তি মহামায়ার দৃশ্যমান স্বরূপ।বিষয়টি শ্রীচণ্ডীতেও বলা আছে।

প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।
স্ত্রিয়ঃ শ্রিয়শ্চ গেহেষু ন বিশেষােঽস্তি কশ্চন।।
উৎপাদনমপত্যস্য জাতস্য পরিপালনম্।
প্রত্যহং লােকযাত্রায়াঃ প্রত্যক্ষং স্ত্রীনিবন্ধনম্।।
অপত্যং ধর্মকার্যাণি শুশ্রূষা রতিরুক্তমা।
দারাধীনস্তথা স্বর্গঃ পিতৃণামাত্মনশ্চ হ।।
(মনুসংহিতা:৯.২৬-২৮)

“স্ত্রীলােকরা সন্তান প্রসব ও পালন করে বলে তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবর্তী। এ কারণে তারা বহুসম্মানের যােগ্য। নারীরা গৃহের দীপ্তি অর্থাৎ প্রকাশস্বরূপ। পুরুষের ধনৈশ্বর্য থাকলেও যদি ভার্যা না থাকে, তা হলে বাড়ীতে বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজনেরা উপস্থিত হলে গৃহস্বামী নিজে তাদের প্রত্যেককে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পান-ভােজনাদির দ্বারা আপ্যায়িত করতে পারে না।

সন্তান উৎপাদন ও জাত সন্তানের পরিপালন এবং প্রতিদিন লোকযাত্রা নির্বাহরূপ অতিথিসেবা, ভিক্ষাদান প্রভৃতি গৃহস্থের যে সব কাজ, স্ত্রীলােকেরাই এই সব কাজ অন্তরঙ্গভাবে সম্পাদন করে।
সন্তানের উৎপাদন, অগ্নিহােত্রাদি পঞ্চমহাযজ্ঞ সহ সকল প্রকারের ধর্মকর্ম সম্পাদন, সকলের পরিচর্যা, রতি-সুখ, সন্তানের মাধ্যমে পিতৃগণের পরিতৃপ্তি এ সকল কাজ পত্নীর দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়।”

১৩. নারী-শিশু হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে:

নারী, শিশু ও জ্ঞানীদের যারা হত্যা করে, তাদের মত পাপী আর নেই। তাই তাদের মৃত্যুদণ্ডের মত কঠিনতম শাস্তি প্রদান করতে হবে।

কূটশাসনকর্তৃংশ্চ প্রকৃতীনাঞ্চ দূষকান্।
স্ত্রীবালব্রাহ্মণঘ্নাংশ্চ হন্যাদ্দ্বিটসেবিনস্তথা।।
(মনুসংহিতা: ৯.২৩২)

“যারা মিথ্যা রাজাজ্ঞা লেখে বা প্রচার করে, যারা অমাত্যাদি রাজ প্রকৃতিদের মধ্যে ভেদ ঘটায়, যারা স্ত্রীলােক, বালক ও ব্রাহ্মণকে বধ করে এবং যারা রাজার শত্রুপক্ষের সাহায্য করে তাদের বধ করা কর্তব্য।”

১৪.গুণহীন অযোগ্য পাত্রের হাতে কন্যাকে সমর্পণ করবে না:

কন্যাকে বিদ্যা দান করে অবশ্যই বিবিধ প্রকারের গুণ দ্বারা ভূষিত পাত্রের হাতেই সমর্পণ করতে হবে।বিদ্যা, শৌর্যবীর্য, সুদর্শন চেহারা, উপযুক্ত বয়স, উদারহৃদয়, বেদাদি শাস্ত্র অনুগত, সমপর্যায়ের বংশমর্যাদাযুক্ত এবং কন্যার প্রতি অনুরাগ – এগুলো পাত্রের আবশ্যকীয় গুণ। মহর্ষি মনু বলেছেন, এই গুণগুলো যদি কোন পাত্রে না থাকে, তবে সেই পাত্রের কাছে কখনই কন্যা সমর্পণ করা যাবে না। যদি যোগ্য পাত্র না পাওয়া যায় তবে কন্যা ঋতুমতী বয়স থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত পিতৃগৃহেই অবস্থান করবে তাও ভাল।কিন্তু গুণহীন, বিদ্যাহীন, অযোগ্য পাত্রের হাতে কন্যাকে দান করা যাবে না।

উৎকৃষ্টায়াভিরূপায় বরায় সদৃশায় চ।
অপ্রাপ্তামপি তাং তস্মৈ কন্যাং দদ্যাদ্ যথাবিধি।।
কামমামরণাত্তিষ্ঠেদ্ গৃহে কন্যর্তুমত্যপি।
ন চৈবৈনাং প্রযচ্ছেত্তু গুণহীনায় কর্হিচিৎ।।
(মনুসংহিতা:৯.৮৮-৮৯)

“উৎকৃষ্ট অভিরূপ এবং যোগ্য বর পাওয়া গেলে কন্যা বিবাহের বয়স প্রাপ্ত না হলেও তাকে যথাবিধি সম্প্রদান করবে।
কন্যা ঋতুমতী হয়ে মৃত্যুকাল পর্যন্ত পিতৃগৃহেই অবস্থান করবে সেও বরং ভাল, তবুও গুণহীন পাত্রের হাতে ঐ কন্যাকে দান করবে না।”

১৫.কন্যা স্বরংবরা হয়ে নিজের যোগ্য পাত্র নিজেই খুঁজে নিতে পারবে:

কন্যার সময়কালে সৎপাত্রে বিয়ে দেয়া পিতার অত্যন্ত আবশ্যকীয় দায়িত্ব। কিন্তু কন্যার সময়কালে বিয়ের না হয়ে, বিয়ের বয়স যদি অতিক্রম করে যেতে থাকে তবে কন্যা নিজেই নিজের যোগ্য পাত্র নির্বাচন করে নিতে পারবে।

ত্রীণি বর্ষাণ্যুদীক্ষেত কুমার্যৃতুমতী সতী।
ঊর্দ্ধন্তু কালাদেতস্মাদ্বিন্দেত সদৃশং পতিম্।।
অদীয়মানা ভর্তারমধিগচ্ছেদ্ যদি স্বয়ম্।
নৈনঃ কিঞ্চিদবাপ্নোতি ন চ যং সাঽধিগচ্ছতি।।
(মনুসংহিতা:৯.৯০-৯১)

“কুমারী কন্যা ঋতুমতী হলেও তিন বৎসর পর্যন্ত গুণবান্ বরের অপেক্ষা করবে; ঐ সময় অতিক্রান্ত হলে অর্থাৎ ঐ সময়ের মধ্যে পিতা যদি তার বিবাহ না দিতে পারে তবে ঐ পরিমাণ কাল অপেক্ষার পর কন্যা নিজসদৃশ পতি নিজেই মনােনীত করে নিবে।
ঋতুমতী হওয়ার তিন বৎসর পরেও যদি ঐ কন্যাকে পাত্রস্থ করা না হয়, তাহলে সে যদি নিজেই পতি বরণ করে নেয়, তার জন্য সে কোনও পাপের ভাগী হবে না। কিংবা যাকে সে বরণ করে নিবে, তাকেও কোন পাপ স্পর্শ করবে না।”

মনুসংহিতার প্রসঙ্গে উঠলে আমাদের অনেকের মধ্যে আজও একগাদা অজ্ঞানতাপ্রসূত নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। আমরা অনেকেই ভুলে যাই যে, মনুসংহিতা একটি আইন, শাসন এবং দণ্ডবিধির গ্রন্থ। গ্রন্থটি যে কালে এবং যে ভৌগোলিক পরিবেশে রচিত হয়েছে, তার একটি সুনির্দিষ্ট ছাপ গ্রন্থটিতে রয়েছে । বিষয়টি অন্যান্য আইনের গ্রন্থের মত মনুসংহিতাতেও আছে। জগতের সকল আইনের গ্রন্থেই কিছু না কিছু বিষয় বা আইন থাকে যা কারো না কারো অপছন্দ থাকে। কিন্তু তাই বলে গুটিকয়েক অপছন্দের আইনের কারণে কেউ কখনো সম্পূর্ণ আইনের গ্রন্থকে পরিত্যাগ করে না। অথবা যিনি পরিত্যাগ করতে চান, তিনি হয় বোকার স্বর্গে বসবাস করেন অথবা তিনি মহাধূর্ত, মহাপ্রবঞ্চক।কথাগুলো মনুসংহিতার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে প্রযোজ্য। মহর্ষি মনু রচিত মনুসংহিতায় প্রায় আড়াইহাজার শ্লোকের মধ্যে কারো যদি সর্বোচ্চ শতশ্লোক অপছন্দ হয়, তবেও গ্রন্থটি পরিত্যজ্য নয়। আজও অসংখ্য মানবিক বিধান সহ ধর্মীয় অধিকাংশ বিধানই আমরা মনুসংহিতাতে পাই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, বর্তমানে কিছু মানুষ মনুসংহিতার বিরোধিতা করছে। এ বিরোধিতার পেছনে যুক্তিতর্কের থেকে রাজনৈতিক আত্মপ্রচার, রাজনৈতিক দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসই তাদের মুখ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নেতা হওয়ার যোগ্যতা নেই, কিন্তু নেতা হওয়ার এক সুতীব্র মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতেও এ রাজনৈতিক সামাজিক ব্যক্তিগণ মনুসংহিতার বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ ছড়িয়ে অনুসারীদের লেলিয়ে দিচ্ছেন। যা আবহমান এ ভূখণ্ডের শাশ্বত সংস্কৃতির জন্যে অকল্যাণকর।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়