Saturday, July 27, 2024
সম্পাদকীয়

কল্যাণের প্রতীক ‘স্বস্তিকা’

কলকাতা ট্রিবিউন ডেস্ক: সারা পৃথিবীব্যাপী খ্রিস্টান সম্প্রদায় সেবার প্রতীক হিসেবে তাদের ধর্মের প্রতীক রেডক্রস চিহ্ন ব্যবহার করে। তাদেরকে অনুসরণ করে মুসলিম সম্প্রদায়ও তাদের ধর্মের প্রতীক ক্রিসেন্টকে (বাঁকা চাঁদ) সেবার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। সর্বশেষে ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষেরাও তাদের তাদের ধর্মের পবিত্র প্রতীক রেডস্টার (রেড সিল্ড অফ ডেভিড /মেজেন ডেবিড এডম) ব্যবহার করছে ডাক্তার, চিকিৎসাক্ষেত্র সহ সকল মানবিক সেবার প্রতীক হিসেবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি তাদের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতীককে সেবার প্রতীক হিসেবে, মানবতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করলেও; এদেশীয় হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাদের ধর্মীয় প্রতীক মানবতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেনি বা করতে পারেনি। হিন্দু, জৈন এবং বৌদ্ধ সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। পৃথিবীর এ বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর মানুষদের উচিত ছিল, অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত তাদের পবিত্র প্রতীককে মানবতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতে আন্তর্জাতিক সমর্থন এনং স্বীকৃতি নিয়ে আসা। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। এককথায় বলতে গেলে, এ বিষয়টিতে আজ পর্যন্ত কেউ খুব একটা প্রচেষ্টাও করেনি। যা প্রচেষ্টা হয়েছে সকলই সীমিত পরিসরে। 

স্বস্তিকা চিহ্নটি প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষের

মঙ্গল, সেবা,শান্তি এবং কল্যাণময় ঈশ্বরের প্রতীক বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ সেবার প্রতীক স্বস্তিকা (卐) চিহ্ন শুধুমাত্র সনাতন ধর্মের নয়; বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদেরও পবিত্র প্রতীক।বৌদ্ধদের ধর্মচক্রের পর দ্বিতীয় প্রতীক। ব্যবহারগত দিক থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওঙ্কারের (ॐ) পরে দ্বিতীয় পবিত্র প্রতীক হলো স্বস্তিকা (卐)। ওঙ্কার এবং স্বস্তিকা দুটো প্রতীকের লক্ষ্য পরমেশ্বর। ঋগ্বেদ সংহিতা সহ বেদের বিভিন্ন স্থানেই ‘স্বস্তি’ বা ‘স্বস্তিকা’ সম্পর্কিত বিভিন্ন মন্ত্র দৃষ্ট হয়।

স্বস্তি ন ইন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবাঃ

স্বস্তি নঃ পূষা বিশ্ববেদাঃ।

স্বস্তি নোস্তার্ক্ষ্যো অরিষ্টনেমিঃ

স্বস্তি নো বৃহস্পতির্দধাতু।।

(ঋগ্বেদ ১.৮৯.৬) 

“বৃদ্ধশ্রবা ইন্দ্র আমাদের মঙ্গল করুন; সকল জ্ঞানের আধার ও জগতের পোষক পূষা আমাদের মঙ্গল করুন; অহিংসার পালক তার্ক্ষ্য অরিষ্টনেমি এবং বৃহস্পতি আমাদের মঙ্গল করুন।”

স্বস্তি নো মিমীতামশ্বিনা ভগঃ

স্বস্তি দেব্যদিতিরনবর্ণঃ।

স্বস্তি পূষা অসুরো দধাতু নঃ 

স্বস্তি দ্যাবাপৃথিবী সুচেতনা।। 

স্বস্তি পন্থামনু চরেম সূর্য্যাচন্দ্রমসাবিব।

পুনর্দদতাঘ্নতা জানতা সং গমেমহি।।

(ঋগ্বেদ: ৫.৫১.১১,১৫)

“অশ্বিদ্বয় আমাদের কল্যাণ বিধান করুন। ভগ ও দেবী অদিতি আমাদের কল্যাণ বিধান করুন। অপ্রতিহত প্রভাব অসুর পূষা আমাদের কল্যাণ বিধান করুন। দ্যাবাপৃথিবী আমাদের মঙ্গল করুন।

সূর্য্য ও চন্দ্রের ন্যায় নির্বিঘ্নে আমরা কল্যাণমার্গে চলব।আমরা যেন উপকার পরিশোধকারী কৃতজ্ঞ ও অসন্দিগ্ধচিত্ত বন্ধুগণের সাথে মিলিত হতে পারি।”

আমাদের প্রত্যেকটি পূজা এবং যজ্ঞের আগেই ঋগ্বেদ, সামবেদ,যজুর্বেদ এবং অথর্বদেবের স্বস্তিমন্ত্রগুলো পাঠ করে ঈশ্বরের প্রতি পূজা বা যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্নকরণের প্রার্থনা করা হয়। স্বস্তিকা চিহ্নের মধ্যে ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং লয়ের দুটি রূপই বিরাজিত। ঘড়ির কাটার দিকে, অর্থাৎ ডানদিকে ঘূর্ণায়মান স্বস্তিকা চিহ্নটি হল ঈশ্বরের বিশ্বজগত সৃষ্টির রূপ। এর বিপরীতে ঘড়ির কাটার উল্টাদিকে অর্থাৎ বামদিকে ঘূর্ণায়মান স্বস্তিকারূপটি হল ধ্বংসের প্রতীক। জার্মানির এডলফ হিটলার স্বস্তিকার ঘড়ির কাটার উল্টাদিকে বামদিকে ঘূর্ণায়মান স্বস্তিকার ধ্বংসের রূপটি গ্রহণ করেছিলেন।রামায়ণে দেখা যায় শ্রীরামচন্দ্রের ইক্ষ্বাকুকুলের রাজসভার আসনে ‘স্বস্তিক’ চিহ্নযুক্ত আস্তরণমণ্ডিত ছিল।

শাতকুম্ভময়ীং রম্যাং মণিহেমসমাকুলাম্।

সুধর্মামিব ধর্মাত্মা সগণঃ প্ৰত্যপদ্যত৷৷ 

স কাঞ্চনময়ং পীঠং স্বস্ত্যাস্তরণসংবৃতম্।

অধ্যাস্ত সর্ববেদজ্ঞো দূতাননুশশাস চ৷৷ 

(রামায়ণ: অযোধ্যাকাণ্ড, ৮১.১০-১১)

“সকল বেদশাস্ত্রে অভিজ্ঞ ধর্মাত্মা বশিষ্ঠদেব সুবর্ণ নির্মিত মণিময় রমণীয় দেবসভাতুল্য সেই রাজসভাগৃহে সশিষ্য প্রবেশ করে ‘স্বস্তিক’ চিহ্নযুক্ত আস্তরণমণ্ডিত আসনে উপবেশনপূর্বক দূতগণকে আদেশ করলেন।”

স্বস্তিকার প্রসঙ্গ আসলেই কিছু মানুষ অপ্রাসঙ্গিকভাবে জার্মানির এডলফ হিটলারের এবং তার তৈরি নাৎসিবাহিনী প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, স্বস্তিকার ঐতিহ্য পুরাতাত্ত্বিকভাবেই ৮-১০ হাজার বছরের। প্রাচীন ভারতবর্ষের মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, মেহেরগর সহ সারাবিশ্বের বহু দেশেই পাওয়া যায় স্বস্তিকা চিহ্ন ব্যবহারের পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ। অবশ্য আমাদের বিশ্বাস, স্বস্তিকা চিহ্নকে কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ করা যায় না। সৃষ্টির শুরু থেকেই সর্বজনীন স্বস্তিকা চিহ্ন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেই সর্বজনীন পবিত্র স্বস্তিকা চিহ্ন নিয়ে যদি হিটলারের মত কোন বর্ণবাদী অসভ্যতা, নৃশংসতা চালায় তাহলে এই নৃশংসতার দায়ভার কি স্বস্তিকা চিহ্নের? চাঁদতারা হল মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতীক, এই চাঁদতারা প্রতীকের অপব্যবহার করে পাকিস্তানী বাহিনী এদেশীয় মানুষদের উপরে যে অসভ্যতা, বর্বরতা করেছে; সেই অসভ্যতা বর্বরতার দায়ভার কি চাঁদতারা চিহ্নের?কেউ যদি বলে, পাকিস্তানীদের অসভ্যতার দায়ভার চাঁদতারা প্রতীকের, তাহলে বুঝতে হবে সে বোকার স্বর্গে বাস করে।

আমরা যদি ইউরোপ এবং আরব ভূখণ্ডের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেই, তবে দেখতে পাব; তাদের ক্রুসেড এবং জিহাদ নামক ধর্মীয় যুদ্ধের সময়ে উভয়েরই ধর্মীয় প্রতীক ‘ক্রুশ’ এবং ‘চাঁদতারা’ নিজ নিজ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ব্যবহার করেছে। এ যুদ্ধগুলোতে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। কিন্তু এ রাজনৈতিক ক্ষমতার যুদ্ধগুলোর জন্যে তাদের ধর্মীয় প্রতীককে কেউ নেতিবাচক দৃষ্টিতে চিহ্নিত করে না। তবে আশ্চর্য হলেও সত্য, শুধু ব্যতিক্রম স্বস্তিকা চিহ্ন। স্বস্তিকার প্রসঙ্গ আসলেই কিছু মানুষ হিটলারের প্রসঙ্গ নিয়ে আসে, কিছু মানুষ আর্য-অনার্য প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। স্বস্তিকা প্রসঙ্গে এ আর্য-অনার্য বিষয়টি পাওয়া যায়, কিছু বামপন্থীদের লেখালেখি এবং বক্তব্যে। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, স্বস্তিকা যদি বর্ণবাদের চিহ্ন হত, তবে গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর বর্দ্ধমান কখনই এ পবিত্র চিহ্নটি তাদের ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতেন না।গৌতম বুদ্ধ সহ পূর্ববর্তী ছাব্বিশ বুদ্ধ এবং মহাবীর বর্দ্ধমান সহ পূর্ববর্তী তেইশজন তীর্থঙ্করদের বিভিন্ন মূর্তিতে স্বস্তিকা চিহ্ন খচিত থাকত না। স্বস্তিকা যদি বহিরাগত বর্ণবাদীদের চিহ্নই হত, তবে বৌদ্ধ এবং জৈন এ দুটি সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থে স্বস্তিকা চিহ্নের ব্যবহার অন্তত থাকত না।

স্বস্তিকাকে সেবার প্রতীকে পরিণত করার দাবী আজকের না, ব্রিটিশ ভারতেই এ দাবী ওঠে স্বদেশীদের পক্ষ থেকে।১৯২২ সালে ‘রেড স্বস্তিকা সোসাইটি’ তৈরি হয় চীনে। এই সংস্থার হেড কোয়াটার বর্তমানে তাইওয়ানে অবস্থিত। মানবিক সেবাদানকারী রেড স্বস্তিকা সোসাইটি রেডক্রস সংস্থার কাছে রেড স্বস্তিকা চিহ্নের পক্ষে দাবী জানিয়ে আসছে বহুদিন থেকেই। তাদের দৃষ্টিতে স্বস্তিকা চিহ্ন হল, বুদ্ধ এবং ধর্মের প্রতীক।

শুভ মাঙ্গলিক চিহ্ন হিসেবে স্বস্তিকা চিহ্নটি সকল দেবদেবী পূজার ঘটে ব্যবহৃত হয়। বাঙালিরা অবশ্য স্বস্তিকার সাথে সাথে তাদের নিজস্ব মাঙ্গলিক চিহ্ন পুত্তলিকা চিহ্ন ব্যবহার করে।স্বস্তিকাকে সূর্যের প্রতিরূপ (Solar Symbol) বলে মনে করা হয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায় স্বস্তিকাকে ধ্যানস্থ বুদ্ধদেবের তির্যকভাবে স্থাপিত পদদ্বয় হিসেবে মনে করে। সকল পূজার পূর্বে যেহেতু ভগবান গণেশের পূজা হয়, তাই ঘটে স্বস্তিকা চিহ্নের ব্যবহারকে সিন্দুর রেখাঙ্কিত সিদ্ধিদাতা গণেশ মূর্তি মনে করা হয়। জৈন সম্প্রদায় স্বস্তিকা চিহ্নকে তাদের চতুর্বিংশ তীর্থঙ্করের চিহ্নবিশেষ মনে করে। মহাভারতেও ভগবান শিব এবং বিষ্ণু উভয়কেই ‘স্বস্তি’ নামে অবিহিত করা হয়েছে। বিষ্ণুপূজায় শ্বেত,পীত, রক্ত এবং কৃষ্ণবর্ণ চূর্ণে স্বস্তিকাকারে বিশেষ মণ্ডল রচনা করাকে স্বস্তিকমণ্ডলী বলে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সংবিধান হিসেবে খ্যাত হরিভক্তিবিলাস গ্রন্থের চতুর্থ বিলাসের ১৯ শ্লোকে মাঙ্গলিক স্বস্তিকমণ্ডলী তৈরি সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দর করে বলা আছে।

বিদিগ্ গতচতুষ্কাণি ভিত্বা যােড়শধা সুধীঃ।

 মার্জয়েৎ স্বস্তিকাকারং শ্বেতপীতারুণাসিতৈঃ।

মাঙ্গলিক এ ‘স্বস্তি’ শব্দটি উচ্চারণ করে আজও ভারতবর্ষে সকল শুভকামনা জানানো হয়। গুরুজনেরা আশীর্বাদ করেন এ শব্দটি উচ্চারণ করে। তাই এ ভূখণ্ডের অধিবাসী আমাদের সবার উচিত সর্বজনীন স্বস্তিকা চিহ্নকে সেবার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার শুরু করা। নিজেরা ব্যবহার শুরু করে, অন্যদের উৎসাহিত করা। এরজন্যে প্রয়োজন শুধুই, সামান্য সচেতনতা; অন্য কিছুই নয়। এ বিষয়ে সকলের বিশেষ করে এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত ডাক্তারদের সক্রিয় পদক্ষেপ প্রয়োজন।কারণ তারাই পারবে এই স্বস্তিকা চিহ্নকে সম্মানিত স্থানে প্রতিস্থাপন করতে। তারা যদি এ চিহ্নটিকে সেবার চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার শুরু করে ; তবে সাধারণ মানুষেরাও তাদের অনুসরণ করবে এবং ব্যবহার করবে।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়