Sunday, May 19, 2024
আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশের সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ শক্তিপীঠ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উত্তেজনা: ইসকনের কাছে মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণের দাবী

সংগ্রাম দত্ত: প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী তীর্থক্ষেত্র চন্দ্রনাথ মন্দির শক্তিপীঠ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট, কমেন্ট ও বর্তমান মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। 

গত ২৯ শে ডিসেম্বর ২০২৩ মন্দিরকে কেন্দ্র করে মন্দির সংলগ্ন এলাকায় মারামারি ঘটনাও ঘটেছে যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। এতে কয়েকজন আহত হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেকের মতে মন্দিরটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মন্দিরটি ইসকন বাংলাদেশ-এর কাছে হস্তান্তর করা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য যে , সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আটশ বছর পুরোনা তীর্থস্থান চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ ধাম পাহাড় ও মন্দির নিয়ে এমন বিতর্কিত পোস্ট দেওয়ায়

চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর থেকে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র দৈনিক সমকাল গত ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ” চন্দ্রনাথ মন্দির নিয়ে বিতর্কিত পোস্ট, গ্রেপ্তার ২ ” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন ছেপেছে ।

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলায় পাহাড়ের উপর চন্দ্রনাথ মন্দির ভারতীয় উপমহাদেশে সনাতন ধর্মালম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। 

প্রতিবছর বাংলা ফাগুন মাসে (ইংরেজি ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস) বড় মেলা হয় যা শিবচতুর্দশী মেলা নামে পরিচিত। এ সময় বিদেশের অনেক সাধু-সন্ন্যাসী এবং বিশেষ করে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা থেকে এখানে আসেন। নেপালের রাজা নস্মসিষ স্বপ্নে দেবতার আদেশে উপমহাদেশের পাঁচ কোণে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এগুলো হলো নেপালের পশুপতিনাথ, কাশিতে বিশ্বনাথ, পাকিস্তানে ভূতনাথ, মহেশখালীর আদিনাথ আর সীতাকুণ্ডে চন্দ্রনাথ। 

সনাতন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, সত্যযুগে এখানে মহামুণি ভার্গব বসবাস করতেন। অযোদ্ধার রাজা দশরথের পুত্র শ্রী রামচন্দ্র তাঁর বনবাসের সময় এখানে এসেছিলেন। মহামুণি ভার্গব রামচন্দ্র আসবেন জানতে পেরে তাঁদের জন্য তিনটি কুণ্ড সৃষ্টি করেন এবং এখানে রামচন্দ্রের ভ্রমণকালে তাঁর স্ত্রী সীতা এই কুণ্ডগুলো ব্যবহার করেন। এ কারণেই এখানকার নাম সীতাকুণ্ড বলে অনেকের ধারণা।

পুরাণে আছে, শিবের স্ত্রী সতীর পিতা রাজা দক্ষ যজ্ঞ্যানুষ্ঠান করছিলেন, কিন্তু তিনি শিবকে ছাড়া আর সব দেব-দেবীকে সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেন। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী সে যজ্ঞে আত্মাহূতি দিয়ে দেহত্যাগ করেন। ভগবান শিব তখন সতীর মৃতদেহ নিয়ে প্রলয় নৃত্য করতে থাকেন। পুরো সৃষ্টি ধ্বংস হবে দেখে ভগবান বিষ্ণু শিবের প্রলয় নৃত্য বন্ধ করার জন্য তার সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ফেলে দেন। এই দেহাবশেষ ৫১ খণ্ড করে ৫১ স্থানে ফেলা হয়, তা থেকে ৫১ মাতৃপীঠ বা শক্তিপীঠের সৃষ্টি হয়েছে। পুরাণে উল্লেখ আছে যে, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে সতীর ডান হাত পড়েছে। এই পীঠস্থানটিই ভবানী মন্দির, এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালী। 

বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির। চন্দ্রনাথ মন্দিরের পাদদেশে রয়েছে ক্রমধেশ্বরী কালী মন্দির, ভোলানন্দগিরি সেবাশ্রম, কাছারি বাড়ি, শনি ঠাকুর বাড়ি, প্রেমতলা, শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবাশ্রম, শ্রী রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, গিরিশ ধর্মশালা, দোল চত্বর, এনজি সাহা তীর্থযাত্রী নিবাস, তীর্থ গুরু মোহন্ত আস্তানা, বিবেকানন্দ স্মৃতি পঞ্চবটি, জগন্নাথ আশ্রম, শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, মহাশ্মশানভবানী মন্দির, সয়ম্ভুনাথ মন্দির, গয়াক্ষেত্র জগন্নাথ মন্দির, বিরূপাক্ষ মন্দির, পাতালপুরী, অন্নপূর্ণা মন্দির ইত্যাদি। এখানে ৬টি ধর্মশালা আছে, যার ৩টি বাংলাদেশ রেলওয়ের, সেগুলো ব্রিটিশ আমলে তৈরি।

চন্দনাথ মন্দিরে যাওয়ার পথে ব্যাসকুণ্ডের পশ্চিম পাড়ে এবং ভৈরব মন্দিরের বাম পাশে একটা বিশাল বটগাছ আছে, এটি অক্ষয় বট নামে পরিচিত। সয়ম্ভুনাথ মন্দিরের উত্তর পাশে অন্নপূর্ণা ও বিষ্ণু মন্দির অবস্থিত। এখানে সারাবছর ধরে প্রতিদিন পূজা হয়। সয়ম্ভুনাথ মন্দির হতে বিরূপাক্ষ মন্দির যাবার পথে রাস্তা পূর্ব পাশে একটি বড় শিলাখণ্ড দেখা যায়, যা ছত্র শিলা নামে পরিচিত, কেউ কেউ একে সরস্বতী শিলাও বলে থাকেন। বিরূপাক্ষ মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ মন্দিরের দূরত্ব প্রায় আধামাইল। এটি ভগবান শিবের প্রধান মন্দির। এই মন্দির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২-১৩শ’ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এই মন্দিরে প্রতিদিন পূজা হয়। সয়ম্ভুনাথ মন্দির থেকে সামান্য পূর্ব দিকে গেলে চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাওয়ার পথের বাম পাশে ৩০/৪০টি সিঁড়ি নিচের দিকে গেলেই গয়াক্ষেত্র দেখা যায়। এখানে একটি কুণ্ডের মতো আছে। এই কুণ্ডের মধ্য দিয়ে মন্থন নদী পূর্ব থেকে পশ্চিমে বয়ে গেছে। সয়ম্ভুনাথ মন্দিরের কাছাকাছি সীতা মন্দিরের সামনে পাহাড়ের ওপরে রয়েছে হনুমান মন্দির। 

বিরূপাক্ষ মন্দির থেকে চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাবার পথে রাস্তার পূর্ব দিকে আধামাইলের মতো নিচের দিকে গেলে পাতালপুরী দেখা যায়। এখানে হর গৌরী, দ্বাদশ শালগ্রাম, বিশ্বেশ্বর শিব, পাতালকালী, অষ্টবসু, রূদ্রেশ্বর শিব, গোপেশ্বর শিব, পঞ্চানন শিব, মন্দাকিনী, পাতাল গঙ্গাসহ অন্য দেব-দেবী রয়েছেন। তবে গহীন অরণ্য এবং বিপজ্জনক স্থান হওয়ার কারণে তীর্থযাত্রী ব্যাতীত মানুষ এখানে সহজে যায় না। সয়ম্ভুনাথ মন্দির থেকে বিরূপাক্ষ মন্দিরে যাওয়ার পথে রাস্তার বাম পাশে গিরি গুহার অভ্যন্তরে উনকোটি শিব অবস্থিত।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় তীর্থক্ষেত্রটি কিছুদিন যাবত চন্দ্রনাথ পাহাড়কে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে সম্প্রীতি বিনষ্টের চক্রান্ত চলছে । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশের অনলাইন নিউজ পোর্টাল, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে এর সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়নি।

বর্তমান মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃত্বে কোথায় দুর্বলতা ও সমস্য আছে বলে অনেকের অভিমত। তাই মন্দিরটিতে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অবিলম্বে ইসকন বাংলাদেশ -এর কাছে পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা উচিত বলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেকে মনে করেন।