দেশে ফিরলে আমাকে মেরে ফেলা হবে : তসলিমা নাসরিন
কলকাতা: ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ, মুক্তচিন্তা, লিঙ্গসমতা ও মানবাধিকার বিষয়ে লেখনীর জন্য ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীদের রোষানলে পড়ে ও হত্যার হুমকি পেয়ে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য হন তসলিমা নাসরিন। মাতৃভূমি ছেড়ে গত ২৪ বছরের প্রবাস জীবনে সেই একই পুরনো ভয় এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এতো বছর পর দেশে ফেরার আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি। দেশে ফিরলেই আমাকে মেরে ফেলা হবে।’
তসলিমা নাসরিন আরও বলেন, ‘আমি ইসলাম নিয়ে লেখার কারণে মৌলবাদীরা আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়েছে। তবে তারা জানেনা যে, আমি ইসলাম ছাড়াও অন্য ধর্মগুলোর বিষয়েও লিখেছি। তবে কারো বিরুদ্ধে যায় এমন কথা আমি লিখিনি বরং নারী স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছি।’
লেখিকা জানান, ‘তার কাব্যগ্রন্থ ও সংবাদপত্রের কলামে নারীদের প্রতি মুসলিম মৌলবাদীদের শোষণের কথা লেখায় ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা তার সেময়ের কর্মস্থল ‘খবরের কাগজ’ পত্রিকার অফিস ভাঙচুর করে। এতেই ক্ষান্ত হয়নি ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা। তসলিমা বলেন, ১৯৯৩ সালে তার ‘লজ্জা’ নামক উপন্যাসে বাংলাদেশের মুসলিমদের দ্বারা একটি সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা দেয়ায়, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় মুসলিম মৌলবাদীরা বইটি পোড়ানোসহ তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। সেবার গ্রন্থমেলা কর্তৃপক্ষ তাকে মেলায় প্রবেশ করতে নিষেধ করেন বলেও জানান তিনি।’
ঠিক সেসময়টাতেই উত্তরপ্রদেশে বিখ্যাত বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেয় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। তসলিমা বলেন, প্রতিবেশী দেশের ওই ঘটনার ছাপ বাংলাদেশের উপরও পড়ে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সূত্র ধরেই হঠাৎ করে বাংলাদেশের কোথাও কোথাও হিন্দুদের উপর উগ্র মুসলমানদের অত্যাচার শুরু হয়। এইসব বিষাদময় ঘটনা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন বলেও জানান তিনি। তসলিমা বলেন, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের এইসব বাস্তব ঘটনার প্রতিফলনে লেখা ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি ১৯৯৩ সালে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
My life in Bangladesh. pic.twitter.com/WyqJrvnIxT
— taslima nasreen (@taslimanasreen) 27 March 2018
১৯৯৪ সালের মে মাসে প্যারিসে ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইসলামি ধর্মীয় আইন শরিয়া অবলুপ্তির মাধ্যমে কুরআন সংশোধনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর ফলে ইসলামি মৌলবাদীরা তার ফাঁসির দাবী জানাতে শুরু করে। তিন লাখ মৌলবাদী একটি জমায়েতে তাকে ইসলামের অবমাননাকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালরূপে অভিহিত করে। দেশ জুড়ে তার শাস্তির দাবীতে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে জনগণের ধর্মীয় ভাবনাকে আঘাত করার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয় এবং জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে পরবর্তী দুই মাস লুকিয়ে থাকার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তার জামিন মঞ্জুর হয় এবং তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন বলে জানান তসলিমা নাসরিন।
I can not recognize Bangladesh anymore. Grew up in ’70’s and ’80s. No young woman wore burqa or hijab. This is a new Islamized Bangladesh. Girls and women are forced or brainwashed to wear burqa and hijab. Shopping mall pictures. pic.twitter.com/6qtItVqJSY
— taslima nasreen (@taslimanasreen) 27 March 2018
দেশ ত্যাগ করলেও তিনি ভেবেছিলেন, পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে কিছুদিন পরেই ফের দেশে ফিরে আসতে পারবেন। কিন্তু দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পার হয়ে গেলেও আর দেশে ফেরা হয়নি তাঁর। এ নিয়ে অনেক আক্ষেপ করে তসলিমা বলেন, ‘আমি বরাবরই দেশে ফিরতে চাই। কিন্তু আমার মাতৃভূমি আর আগের পরিস্থিতিতে নাই। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরি ইসলামিক দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। দেশে অহরহ বিজ্ঞানভিত্তিক ও মুক্তমনা লেখক-ব্লগার খুন হয়ে যাচ্ছেন। আর এমন এক সময়ে দেশে ফিরে আসলে- তাকেও খুব সহজেই মেরা ফেলা হবে বলেও জানান তসলিমা।