ভারতবর্ষের সমাজ সংস্কারক আনন্দ মোহন বসু, লীলা নাগ ও ভূপেশ গুপ্তের ঐতিহ্যবাহী বসতবাড়ি বেদখল
সংগ্রাম দত্ত: ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক, শিক্ষানুরাগী ও রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার আনন্দ মোহন বসু , অগ্নিকন্যা ও নারী জাগরণের পথিকৃত লীলা নাগ ও ভাটি বাংলার অপর কীর্তিমান পূরুষ ব্যারিস্টার ভূপেশ গুপ্তের স্থাপত্য-কীর্তির অনন্য নিদর্শন ও পূর্বসূরিদের বসতবাড়ি একশ্রেণীর প্রভাবশালী লোক দখল করে নিয়েছে। স্থানীয় লোকেরা এসব উদ্ধার করে হেরিটেজ বা মিউজিয়াম বানানোর দাবি জানাচ্ছে।
১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলা ইটনা থানার জয়সিদ্ধি গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এক সময় পুর্ব পুরুষের পৈতৃক নিবাস ছিল হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানার জলসুখা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম পদ্মলোচন বসু,মাতার নাম উমা কিশোরী নন্দী মজুমদার। ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসুর মা উমাকিশোরী নন্দী মজুমদার হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার আন্দিউড়া গ্রামের বিখ্যাত নন্দী পরিবারের মেয়ে।আনন্দ বসুর মামার নাম হরনাথ মজুমদার।আনন্দমোহন বসুর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ময়মনসিংহে।
১৮৬২ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় ৯ম স্থান অধিকার করে এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। আনন্দমোহন বসু বিয়ে করেন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভগবান চন্দ্র বসুর কন্যা স্বর্ণপ্রভা বসুকে। বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন হলেন স্বর্ণপ্রভা বসু।
১৮৬৪ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৮৬৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। বিএ পরীক্ষায়ই শীর্ষস্থান অধিকার করেন।
১৮৭০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত প্রেমচাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ইংল্যান্ড চলে যান।
১৮৭৪ সালে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে উচ্চতর গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করেন। অনার্সসহ ডিগ্রী পরীক্ষা তথা ট্রাইপস পরীক্ষা প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। প্রথম ভারতীয় র্যাংলার বা গণিতবিদ হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ভারতবর্ষের তিনজন র্যাংলার ছিলেন। প্রথমজন হলেন ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু, দ্বিতীয়জন হলেন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার কিরন চন্দ্র দে,তৃতীয়জন হলেন নরসিংদী জেলার ভাটপাড়া গ্রামের কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত বা কেজি গুপ্ত।
১৮৭৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিষ্টার পাশ করেন।
১৮৭৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
১৮৭৫ সালে ক্যালকাটা স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন প্রতিষ্টা করেন।
১৮৭৬ সালে কলকাতায় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৮৭৮ সালের ১৫ মে ব্রাক্ষ সমাজ প্রতিষ্টা করেন। স্ত্রীসহ ব্রাক্ষ ধর্ম গ্রহন করেন।
১৮৭৯ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর সহযোগিতায় কলকাতায় সিটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । এটি এখন কলকাতা আনন্দমোহন কলেজ।
১৮৮২ সালে ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিটির সদস্য হন।
১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহ শহরে ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন নামে বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা বর্তমানে আনন্দমোহন কলেজ।
১৮৮৩ সালে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের একটি জাতীয় সভার আলোচনা সভার আহবান করেন।এই এসোসিয়েশনই ” ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস” এ পরিনত হয়।
১৮৮৪ সালে ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন।
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্টার অন্যতম সদস্য ছিলেন।
১৮৯০ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন।
১৮৯২ সালে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় Calcutta University Act of Incorporation সংশোধন করা হয়। যার কারনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গীয় আইন পরিষদে একজন সদস্য নির্বাচন করার অধিকার লাভ করেন।
১৮৯৫ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
১৮৯৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন।
১৯০৬ সালের ২০ আগষ্ট ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরন করেন।
ময়মনসিংহ জেলা শহরের রামবাবু রোড এলাকায় অবস্থিত বর্তমান সিটি কলেজিয়েট স্কুলটি ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসুর পৈতৃক নিবাস।
গত ২৩ শে সেপ্টেম্বর ২০২১ জাতীয় দৈনিক যুগান্তরে “স্মরণীয় কীর্তির বিস্মৃত পুরুষ” শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান লিখেছেন যে আনন্দমোহন বসুর স্মৃতিবিজড়িত তাঁর জন্ম স্থান জয়সিদ্ধিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপত্য-কীর্তির অনন্য নিদর্শন, তাঁর পূর্বসূরিদের বসতবাড়িটি বর্তমানে বেদখল।
জানা গেছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মোহাম্মদ আব্দুল হাই নামের স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা আনন্দমোহন বসুর বিশাল আয়তনের এ বাড়িটিকে দখল করে রেখেছেন।
যুগান্তরের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমান প্রতিবেদনে আরো লিখেছেন যে র্যাংলার আনন্দমোহন বসুর জন্ম ভিটার এখন বেহালদশা। বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি বিখ্যাত এ সমাজ সংস্কারকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি বেদখল হয়ে আছে। ফলে অরক্ষিত জন্মভিটায় অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন বসতবাড়িটি।
কয়েক একর আয়তনের বাড়িটিতে রয়েছে কয়েকটি বিশাল ভবন, খোলা মাঠ ও একাধিক পুকুর। বিশাল বসতবাড়িটি পরিণত হয়েছে পরগাছা উদ্ভিদের বাসস্থানে। চারদিকে নির্মিত প্রতিরক্ষা দেওয়ালের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দেওয়ালের অনেক জায়গার ইট-পাথর দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে। আনন্দমোহন বসুর আঁতুড়ঘরটিকে বানানো হয়েছে গোবরের গর্ত। এ অবস্থায় ঐতিহ্যের নিদর্শন এসব স্থাপনা বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী আনন্দমোহন বসুর জন্ম স্থান ও বসতবাড়ি দেখার জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রায়ই দর্শণার্থীরা আসেন। কিন্তু বসতবাড়িটি বেদখল হয়ে থাকায় বাড়িটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত পর্যায়ে চলে গেছে। এরপরও বসতবাড়িটি উদ্ধার কিংবা সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ বা আগ্রহ নেই প্রশাসন কিংবা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক এ স্থানটিকে সংরক্ষণ করে তাঁর পণ্য স্মৃতি ও স্থাপত্যকীর্তির প্রতি সম্মান জানাবে, এ প্রত্যাশা এলাকাবাসীসহ বসুর ঐতিহ্য।
গত ৩ মে ২০১৮ দেশের স্বনামধন্য ইংরেজি পত্রিকা দি ডেইলি স্টার ঐতিহ্য বাড়িটি সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান এর এক সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, “জয়সিদ্ধি গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে বসুর পূর্বপুরুষ জয়রাম ও সিদ্ধিরাম বসুর নামে। “১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় বোস পরিবারকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। তখনই আমির উদ্দিন জমি দখল করে নেন।
প্রায় আট বছর আগে মারা যাওয়া আমির উদ্দিন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। এই সম্পত্তির বর্তমান দখলদারদের পিতা। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফজলুর বলেন, বর্তমান দখলদারদের পিতা সংলগ্ন আলগাপাড়ার স্বাধীনতাবিরোধী নেতা ছিলেন।
“মুক্তিযুদ্ধের সময় আমির স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন বলে ইটনা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নজরুল ইসলাম ঠাকুর ডেইলি স্টারের প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
স্পষ্টভাষী রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমান বলেছেন প্রথমে আমির সম্পত্তিটি ‘লিজ’ নিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় সম্প্রদায় তাকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে তিনি পুনরায় দখলে ফিরে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐতিহ্যবাহী এ বাড়ি থেকে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়েছিল। বোসের গ্রন্থাগারের শত শত বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বাড়ির সামনে দুটি বড় পুকুর ছিল কিন্তু সেগুলি কয়েক বছর ধরে ভরাট হয়ে গেছে।”
সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ বোস সম্পত্তি দখল মুক্ত করে একটি পাবলিক হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করার দাবি জানান।
আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল একমত হন, “কোনও ইজারা থাকলে তা বাতিল করা উচিত। “বোসের সম্পত্তি দখলমুক্ত করা উচিত। সেই জমি বৃহত্তর ময়মনসিংহের জন্য অমূল্য ঐতিহ্য এবং জনসাধারণের কাজে ব্যবহার করা উচিত। আমরা শীঘ্রই এটি মুক্ত করার জন্য একটি আন্দোলন শুরু করব ।”
কিশোরগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ আসাদ উল্লাহ একইভাবে সম্পত্তি উদ্ধার করে জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
স্থানীয় সংগঠন জাগোরিতো ইটনার আহ্বায়ক কামরুল হাসান খান জুয়েল বলেছেন, “গত বছর বসতবাড়ি ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল।
আমিরের ছেলে এবং জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাই তার বাবা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। “আমার বাবা ১৯৬৭ সালে বোস পরিবারের প্রায় দুই একর জমি লিজ নিয়েছিলেন তিনি বলেছেন। “মুক্তিযুদ্ধের পর ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নবায়ন করা হয়। আমার বাবা স্থানীয় শান্তি কমিটির সাথে জড়িত ছিলেন না। এলাকায় এমন কোনো রিপোর্ট নেই।”
ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মশিউর রহমান খান বলেন, ইজারার বৈধতা নিয়ে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। “যতদূর আমি জানি দুই একর জমি লিজ নেওয়া হয়েছিল, তাই এটি জমি দখল নয়। তিনি বলেছেন “যেহেতু কোনো অভিযোগ করা হয়নি আমার তদন্ত করার সুযোগ নেই।”
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখী রায় বলেন, সম্পত্তি অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত নয়। “আমরা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য শীঘ্রই সাইটে একটি দল পাঠাব। যদি জায়গাটিকে সংরক্ষণের যোগ্যতা বলে মনে করা হয় তবে আমরা সেই অনুযায়ী এগিয়ে যাব।”
অপর দিকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিকন্যা ও নারী জাগরণের পথিকৃত লীলা নাগ এর বর্তমান বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামের পৈত্রিক বাড়িটি জবর দখল করে নিয়েছে রাজনগর শান্তিকমিটির তৎকালীন প্রভাবশালী চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আলাউদ্দিন চৌধুরী। এলাকার মানুষের দাবি বাড়িটি উদ্ধার করে সেখানে লীলা নাগের স্মৃতি রক্ষার উদ্যেগ গ্রহন করার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিল্পবী নারী এবং বাংলা ভাষায় মহিলা সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা মাসিক জয়শ্রী পত্রিকার সম্পাদিকা লীলা নাগের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর লীলা নাগ ও অনিল রায় দম্পতি পূর্ববঙ্গে বসবাস করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তৎকালীন মুসলিমলীগ শাসকেরা তাঁদেরকে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করে। মূলত ওই সময়েই লীলা নাগ এর পৈত্রিক বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এবং স্থানীয় রাজাকার আলাউদ্দিন চৌধুরী শত কোটি টাকার ১৭ একর ফসলি জমি ও বাড়িটি দখলে নিয়ে লীলা নাগের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলছে। এলাকার চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আলাউদ্দিন চৌধুরী বাড়িটি জবরদখল করে লীলা নাগের সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলে পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ করে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে। বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী এ বাড়িটি জবরদখল মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। বাড়িটি দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করে লীলা নাগের স্মৃতি রক্ষার্থে সংরক্ষণ করে এখানে একটি জাদুঘর গড়ে তোলার দাবি করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
জানা গেছে আলাউদ্দিন চৌধুরী বাড়িটি রক্ষায় মৌলভীবাজার জেলা জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। সে মামলায় তিনি পরাজিত হলে উচ্চ আদালতে আপীল করেছেন। মামলাটি এখনো চলছে।
লীলা নাগের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বাড়ির বৈঠকখানাটি ঝরাঝির্ণ অবস্থায় এখনো টিকে আছে। তাও ময়লা-আবর্জনায় পরিপূণ বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী এ বাড়িটি জবরদখল মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। প্রয়াত যুদ্ধাপরাধী আলাউদ্দিনের পরিবারের হাত থেকে বাড়িটি উদ্ধার ও সরকারের সংলিষ্ট মহলের তত্ত্বাবধানে লীলা নাগের স্মৃতি রক্ষার্থে সংরক্ষণ করে এখানে একটি জাদুঘর গড়ে তোলার দাবি করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
এলাকাবাসি জানান, আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৬ মে গভীর রাতে পাক হানাদার বাহিনীকে দিয়ে সংখ্যালঘু নিরীহ গ্রামবাসিকে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। লোকজনকে ধরে স্থানীয় দীঘির পাড়ে ব্রাসফায়ার করে নারী শিশুসহ ৫৯ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে দীঘিতে লাশ ফেলে দেয়। পরে লাশ উদ্ধার করে দীঘির পশ্চিমপাড়ে গণকবর দেয়া হয়। আলাউদ্দিন চৌধুরী বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত শুরু করলে এসময় আলাউদ্দিন চৌধুরী গাঁ ঢাকা দেন। পরে পলাতক থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
উপমহাদেশের প্রথম বাঙালী মহিলা সাংবাদিক লীলা নাগের জন্ম ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর ভারতের আসাম প্রদেশের গোয়ালপাড়া গ্রামে।
তাঁর পিতা গিরীশচন্দ্র্র নাগ আসাম সরকারের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেই সুবাধে চাকুরী সূত্রে লীলা নাগের পরিবার আসামের বাসিন্দা হয়। মা কুঞ্জলতা নাগ ছিলেন সুগৃহিনী।
১৯০৫ সালে আসামের দেওগর বিদ্যালয়ে লীলা নাগের শিক্ষা জীবনের শুরু সেখানে দুই বছর অধ্যায়নের পর ভর্তি হন কোলকাতার ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে।
১৯১১ সালে ঢাকার ইডেন হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৭ সালে ওই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
১৯১৬ সালে লীলা নাগের পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ চাকুরী হতে অবসর গ্রহনের পর স্থায়ীভাবে সপরিবারে বাংলাদেশে চলে আসেন।
১৯১৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর লীলা নাগ উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের জন্য কোলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। সে কলেজে সেরা ছাত্রী ছাড়াও ছবি আঁকা, গান ও বিভিন্ন খেলাধুলায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ জন্য কলেজের সবার মধ্যমণি ছিলেন লীলা নাগ। কলেজের রি-ইউনিয়নের উদ্যোক্তা হিসেবে সিনিয়র স্টুডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সবাইকে চমকে দেন।
কলেজে শিক্ষাকালীন সময়ে লীলা নাগ ‘লোকমান্য তিলক’ র মৃত্যু দিবস উপযাপনকে কেন্দ্র করে কলেজ অধ্যক্ষর সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন এবং ছাত্র-ধর্মঘটের ডাক দেন। এছাড়া ‘বড়লাট’ কে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানানোর প্রথা বাতিলের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন।
১৯২১ সালে লীলা নাগ মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এ পাশ করেন এবং পদ্মাবতী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ঐ বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেন। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষা অর্থাৎ সহ শিক্ষা চালু ছিলো না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. রবার্ট হার্টস লীলা নাগের মেধার প্রতি শুদ্ধা রেখে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী (মহিলা) হিসেবে ইংরেজী বিষয়ে মাষ্টার্স শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাবস্থায় লীলা নাগ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লা চন্দ্র ও ঋষি রামানন্দের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯২৩ সালে লীলা নাগ ইংরেজী বিষয়ে দ্বিতীয় বিভাগে মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। লীলা নাগসহ তার অনেক বান্ধবী-সহপাঠী গোপন বিল্পবী দলের সদস্য ছিলেন।
১৯২৩ সালে লীলা নাগ আবহমান বাংলার নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের এনা রায়, সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অপূর্ব চন্দ্র দত্তের মেয়ে বীণা দত্ত ও সরোজ বসু, ব্যারিষ্ট্রার পি.কে বসুর মেয়ে কমলা বসু, তার বোন মনোরমা বসু, ব্রাহ্ম সমাজের ডাঃ নেপাল রায়ের মেয়ে লতিকা রায়, তার বোন লীলা রায়সহ ১২ জনকে নিয়ে গঠন করেন ‘দীপালি সংঘ’। এ সংগঠনের প্রচেষ্টায় নারী শিক্ষা মন্দিরসহ ১২টি অবৈতনিক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। নারীদের স্বউপার্জিত করতে কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় দীপালি সংঘের উদ্যোগে।
নারীদের শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে লীলা নাগ প্রতিষ্ঠা করেন রাজধানীর আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়, শেরেবাংলা মহাবিদ্যালয় এবং কামরুন্নেছা গার্লস হাইস্কুল। ১৯২৬ সালে লীলা নাগ ভারতের কোলকাতায় চলে যান। সেখানেও তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৯২৮ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কোলকাতা কংগ্রেস এবং বাংলার বিল্পবী দলগুলো একত্রিত হয়। সেখানে বিল্পবী লীলা নাগ ও অনিল রায় অংশ নেন। পরবর্তীতে লীলা নাগ আন্দোলন-সংগ্রামের সহযাত্রী অনিল রায়কে বিয়ে করে জীবনসঙ্গী করে নেন। লীলা নাগ বিপ্লবী আন্দোলনে এক বছরের মধ্যে প্রথম সারির নেত্রী হিসেবে আর্ভিভূত হন।
১৯২৭-২৮ সালে সমাজের অবহেলিত নারীদের আশ্রয় ও সাহায্যার্থে মহিলাদের আত্মরক্ষামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থার জন্য ‘নারী আত্মরক্ষা ফান্ড’ খোলেন। ১৯৩০ সালের জানুয়ারি মাসে লীলা নাগের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘মাসিক জয়শ্রী’ পত্রিকা। কবিগুরু ছাড়াও জয়শ্রীতে অভিনন্দনপত্র পাঠান পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বিজয়লক্ষী পন্ডিত, হাজরা বেগম, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। ঐ বছরই লীলা নাগ ও আশালতা সেন এর নেতৃত্বে ঢাকার নারীরা লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন।
এ অন্দোলনে লীলা নাগ মুল সংগ্রামের দায়িত্বে ছিলেন। ঐ বছরের ১৮ এপ্রিল মাষ্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাঘার দখল করেন। এরপর ইংরেজ সরকার বিপ্লবী দলের নেতৃস্থানীয়দের গ্রেফতার শুরু করে। শ্রীসংঘের অনিল রায়ও কারাবরণ করেন। ফলে শ্রীসংঘের সর্বময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন লীলা নাগ। সূর্যসেনের পরামর্শে এ সময় অবিভক্ত ভারতের প্রথম নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা লীলা নাগের কাছে বিপ্লবীরা জীবনের পাঠ বা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লীলা নাগ কারান্তরীন ছিলেন। ১৯৩১ সালে ঢাকার গুলিবর্ষণের অভিযোগে ৩৩টি বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। এসময় লীলা নাগের বাড়ি আগুনে ভষ্মিভূত করা হয়। ঐ বছরের এপ্রিলে বিপ্লবীদের গুলিতে তিন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেড, আলিপুরের জেলা জজ ও কুমিল্লার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেড নিহত হন।
এ ঘটনায় ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর লীলা নাগকে গ্রেফতার করা হয়। লীলা নাগ ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক প্রথম নারী রাজবন্দী। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার লীলা নাগের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক জয়শ্রী প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। ১৯৩৭ সালের ৮ অক্টোবর কারামুক্তির পূর্ব পর্যন্ত লীলা নাগকে ঢাকা, রাজশাহী, সিউরী, মেদেনীপুর ও হিজলী জেলে বন্দী রাখা হয়।
কারামুক্তির পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি দীর্ঘ পত্র লিখেন লীলা নাগকে। ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে পুনরায় মাসিক জয়শ্রী প্রকাশিত হয়। ‘জয়শ্রী’ পুনঃপ্রকাশিত হলে কবিগুরু একটি আশীর্বাদপত্র প্রেরণ করেন। ঐ বছরের ৩ আগষ্ট অনিল রায় কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর অনিল রায় ও লীলা নাগের শ্রীসংঘ রাজনৈতিক দলে রূপান্তরীত হয়। তাঁরা কংগ্রেসে যোগ দেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ট সহকর্মীরূপে তারা আর্ভিভূত হন।
এসময় ঢাকায় ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ (বর্তমান শেরেবাংলা স্কুল ও কলেজ) শিক্ষাভবন পূণঃগঠিত হয়। অনিল রায়ের মায়ের বাড়ি মানিকগঞ্জের রায়রা গ্রামে স্থাপন করা হয় একটি হাই স্কুল। যা শুধুমাধ্য মুসলিম সম্প্রদায়ের কৃষকদের সন্তানদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল।
১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে জলপাইগুড়িতে অনুষ্ঠিত ত্রিপুরা কংগ্রেসের জাতীয় দাবী সম্পর্কিত ‘চরমপত্র’ উপস্থাপন করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তা সমর্থন করেন লীলা নাগ। ঐ বছরের ১৩ মে ৩৯ বছর বয়সে দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের সহকর্মী ও সহযোদ্ধা অনিল রায়কে বিয়ে করেন লীলা নাগ।
বিয়ের পর লীলা নাগের নাম হয় প্রথানুসারে লীলা রায়। ঐ মাসেই অনিল রায় ও লীলা রায় (লীলা নাগ) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদান করেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে সাথে নিয়ে ঢাকা, মানিকগঞ্জ সফর করেন তারা। ১৯৪০ সালের ২৭ জুন ফরোয়ার্ড ব্লকের সম্মেলনে মূল প্রস্তাব উপস্থাপন করেন লীলা রায়।
প্রস্তাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘোষণা ছিল। এর কয়েকদিন পর ঐ বছরের ২ জুলাই হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারন আন্দোলনে জড়িত অপরাধে পুলিশ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে, ৯ জুলাই অনিল রায়কে এবং ১০ জুলাই লীলা রায়কে গ্রেফতার করে। দেড় মাসের অধিককাল কারাবন্দী থাকার পর ২৯ আগষ্ট অনিল রায় ও লীলা রায় দম্পতি মুক্তিলাভ করেন। ঐ বছর সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন লীলা রায়।
১৯৪১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন শরৎচন্দ্র বসু। তাঁর গ্রেফতারে তীব্র নিন্দা জানিয়ে হাজরা পার্কে জনসভায় বক্তব্য রাখেন লীলা রায় ও অনিল রায়। এ অপরাধে তাদের পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর কারাভোগের পর ১৯৪৬ সালের জুন মাসে তারা কারামুক্তি লাভ করেন।
ঐ বছর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাকালে উভয় সম্প্রদায়ের বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার ও নিরাপত্তা বিধানে নামেন লীলা রায় ও অনিল রায়। তারা হাজার হাজার মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপত্তা প্রদান করেন।
১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে নোয়াখালির দাঙ্গার পর সেখানকার রামগঞ্জে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস ইনষ্টিটিউট’ খুলে ১৭টি ক্যাম্পের মাধ্যমে দীর্ঘদিন সেবা ও সহায়তা প্রদান করেন লীলা রায়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর লীলা নাগ (লীলা রায়) ও অনিল রায় দম্পতি পূর্ববঙ্গে বসবাস করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তৎকালীন মুসলিমলীগ শাসকেরা লীলা রায় ও অনিল রায়কে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করে। মূলত ওই সময়েই লীলা রায় (লীলা নাগ) এর মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও-এ অবস্থিত পৈত্রিক বাড়িটি মূলত পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
১৯৫১ সালে তৎকালীন ভারত সরকার উদ্বাস্তুু উচ্ছেদের বিল আনেন। এ বিলের প্রতিবাদ করায় গ্রেফতার হন লীলা রায় (লীলা নাগ)। ১৯৫২ সালে লীলা রায়ের স্বামী অনিল রায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিয়ের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় অকাল বৈধব্য এবং দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের সাথী স্বামী অনিল রায়কে হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েন লীলা রায়।
অল্পদিনের মধ্যে গভীর শোককে কাটিয়ে ওঠে তিনি সমাজ বিপ্লবেব সংগ্রামকে বেগবান করার কাজ শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে লীলা রায় জয়প্রকাশ নারায়নের সমাজবাদী শিবিরে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ মার্চ ‘পূর্ববাংলা বাঁচাও কমিটি’র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে পুলিশ লীলা রায়কে গ্রেফতার করে।
১৯৬৬ সালে মুক্তিলাভের পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেরুয়ারি সকালে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাঁকে কোলকাতার পি.পি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৩ দিন পর সংজ্ঞা ফিরে এলেও বন্ধ হয়ে যায় তাঁর বাকশক্তি। শরীরের ডান অংশ সম্পূর্ণভাবে অচল হয়ে যায়।এ অবস্থায় আড়াই বছর চলার পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন ভারতে উপমহাদেশের মহীয়সী নারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, বাংলা ভাষায় মহিলা সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা মাসিক জয়শ্রী সম্পাদিকা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী লীলা নাগ ওরফে লীলা রায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভাটি বাংলার আর এক কীর্তিমান পূরুষ
ব্যারিস্টার ভূপেশ গুপ্ত ভারত বর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা,বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা থানা সদরে ২০ শে অক্টোবর ১৯১৪ সালে এক সামন্ত ও জমিদার পরিবারে ভূপেশ গুপ্ত জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মহেশ চন্দ্র গুপ্ত।
তিনি কলিকাতা স্কটিশ চার্চ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন।ছাত্র অবস্থাতেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড জড়িয়ে পড়েন। বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়।বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য ১৯৩০ সালে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন।
১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বন্দী জীবন কাটান।কারাগারে অন্তরীণ অবস্থাতেই আইএ বিএ পাশ করেন।মুক্তি পেয়ে লন্ডন যান। সেখানে এলএল বি ডিগ্রি ও মিডল ট্যাম্পল থেকে ব্যারিস্টার পাশ করেন।।
১৯৫১ সালে গ্রেপ্তার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের দমদম জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় রাজ্য সভার সদস্য নির্বাচিত হন।তিনি বরাবরেই এই আসনের সদস্য ছিলেন।
১৯৫২ থেকে টানা ২২ বছর রাজ্য সভার সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৫৭ ১৯৬০ ১৯৬৯ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সন্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।তিনি কলিকাতা হাইকোর্টের ও আইনজীবী ছিলেন। তিনি শুধু আইনজীবীই ছিলেন না ছিলেন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান,সুলেখক,সাংবাদিক,সমাজ কর্মী এবং একজন স্হপতি।
১৯৬৬ সাল থেকে ভারতের নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক এবং দৈনিক স্বাধীনতার সম্পাদকীয় বোর্ডের সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।ভূপেশ গুপ্ত বাংলা ও ইংরেজীতে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ” ফ্রিডম এন্ড দি সেকেন্ড ফ্রন্ট” টেরার অব বেঙ্গল ” ফাইভ ইয়ারস প্লান ” এ ক্রিটিক বি-গ-লুট অন্যতম।
১৯৪৫ সালের ৮এপ্রিল নেত্রকোনা নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত( সর্বভারতীয়) কৃষক সন্মেলনে যোগদান করেন। ৭০ একর জমির উপর প্যান্ডেল নির্মাণ করা হয়েছিল। লক্ষাধিক লোক সমাগম হয়েছিল।পিসি যোশী এই সন্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন।
জানা যায় অনেক পূর্বেই ভূপেশ গুপ্তের পিতা মহেশ চন্দ গুপ্ত ইটনায় একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার মনোবাসনা প্রকাশ করেছিলেন। মহেশ চন্দ্র গুপ্তের সুযোগ্য পুত্র ইটনার কৃতি সন্তান ব্যারিস্টার ভূপেশ গুপ্ত পিতার লালিত বাসনাকে বাস্তবায়িত করলেন।
১৯৪৩ সালে নিজ আবাস ভূমে তাঁর স্বর্গীয় পিতা মহেশ চন্দ্র গুপ্তের নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেন ইটনা মহেশ চন্দ্র শিক্ষা নিকেতন। সূচিত হলো ইটনা মহেশ চন্দ্র শিক্ষা নিকেতনের সুবর্ণ ইতিহাস। এটিই হাওর অধ্যুষিত ইটনা থানার প্রথম হাইস্কুল।যার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন সিলুন্দ্যা গ্রামের ধীরু চৌধুরী। এই স্কুলটির মাধ্যমে গোটা ইটনা ও মিঠামইন সহ সন্নিহিত ভাটি অঞ্চলের মানুষের শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়।বর্তমান প্রজন্ম সহ এর আগের প্রজন্মের খুব বেশী মানুষ ভূপেশ গুপ্তকে জানে না। এসব মনিষী সম্পর্কে যতই জানবো ততই আমাদের লাভ। তাই আমাদের ভাটি বাংলার কৃতি পূরুষদের স্মরণ করা ও তাঁদের জীবনী অনুসরণ করা প্রয়োজন।
ব্যারিস্টার ভূপেশ গুপ্ত চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় মস্কোতে ৬ ই আগস্ট ১৯৮১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বর্তমান বাংলাদেশে তাঁর জন্মভিটা গুপ্ত বাড়িটি প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যে বাড়িটিকে ঘিরে চারদিকের মানুষ আশায় থাকতো খাবার, চিকিৎসা, শিক্ষা,সুবিচারের তীর্থস্থান হিসাবে দেখতো ইটনার সকল ধর্মের মানুষ।
বর্তমানে একশ্রেণীর প্রভাবশালী মহল নানা কৌশলে গুপ্ত বাড়ি ও হাওরের বিশাল সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ব্যারিস্টার ভূপেশ গুপ্তের জন্মভিটা গুপ্ত বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় নিয়ে সংস্কার করা এবং তাঁর নামে বাড়িটিতে একটা জাদুঘর করা, তাহলে কিছুটা হলেও তাঁর কাছ থেকে নেয়া বিশাল ঋণের বোঝা একটু হলেও শোধ হবে। নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে বিপ্লবী ভূপেশ চন্দ্র গুপ্তকে,ইটনায় প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী ভূপেশ চন্দ্র গুপ্ত স্মৃতি সংসদ ইটনা কিশোরগাঞ্জ, এর নেতারা ইটনা পুরান বাজারের কর্মচারী কল্যাণ ক্লাব হতে গুপ্ত বাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটি “কমরেড ভূপেশ চন্দ্র গুপ্ত সড়ক” নামে নামকরণ সহ তার জন্মভিটা ঐতিহাসিক গুপ্ত বাড়িকে সংস্কার করে সরকারি ভাবে সংরক্ষণের জোর দাবি জানায়।