ঢাকার দেবী ঢাকেশ্বরী ভারত ভাগের পর লাখো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতো যেভাবে কলকাতার কুমারটুলিতে উদ্বাস্তু হয়েছিলেন
সংগ্রাম দত্ত:
—————-
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন ১২শ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময়কার নির্মাণশৈলীর সাথে এর স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায় না বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। কেউ কেউ দাবি করেন, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের আগমনের পূর্বে তথা সেন বংশের রাজত্বকালে বাংলার স্থাপত্যশিল্পে চুন-বালি মিশ্রণের ব্যবহার ছিল না। কিন্তু ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি আগাগোড়া চুন-বালির গাঁথনিতে নির্মিত। যা বাংলার মুসলিম আমলেরই স্থাপত্যরীতির বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের গঠন ও স্থাপনার নানা ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে।
ধারণা করা হয়, এটি ঢাকার আদি ও প্রথম মন্দির। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, ঢাকেশ্বরী শব্দ থেকেই ঢাকা নামের উৎপত্তি। ঢাকেশ্বরী দেবী ঢাকা অধিষ্ঠাত্রী বা পৃষ্ঠপোষক দেবী। কিংবদন্তি অনুযায়ী, রাজা আদিসুর তাঁর এক রানীকে বুড়িগঙ্গার এক জঙ্গলে নির্বাসন দেয়। জঙ্গলে রানী প্রসব করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। যার নাম বল্লাল সেন । জঙ্গলেই বেড়ে ওঠে বল্লাল সেন। শৈশবে জঙ্গলের মধ্যে বল্লাল সেন একটি দেবী মূর্তি পান (মতান্তরে, রাজ ক্ষমতায় বসার পর এই জঙ্গলে তিনি মূর্তিটি পান)। বল্লাল সেন বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে জঙ্গলে সকল বিপদ-আপদ থেকে এই দেবী দুর্গাই তাঁকে রক্ষা করছেন। পরে বল্লাল সেন রাজ ক্ষমতায় অসিন হলে তাঁর জন্মস্থানে যেখানে দেবীর মূর্তি পেয়েছিলেন সেখানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মূর্তিটি জঙ্গলে ঢাকা অবস্থায় পেয়েছিলেন বলে দেবীর নাম হয় ‘ঢাকা+ঈশ্বরী’ বা ‘ঢাকেশ্বরী’। মন্দিরটি ‘ঢাকেশ্বরী মন্দির’ নামে পরিচিতি পায়।
অপর কিংবদন্তি মতে রাণী ও রাজা বিজয় সেনের স্ত্রী স্নান করার জন্য লাঙ্গলবন্দ গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় তিনি একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, যিনি বল্লাল সেন বলে পরিচিত হন। সিংহাসনে আরোহণের পর, বল্লাল সেন তাঁর জন্মস্থানকে মহিমান্বিত করার জন্য এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। কিংবদন্তী যে বল্লাল সেন একবার জঙ্গলে আচ্ছাদিত দেবতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বল্লাল সেন সেখানে দেবীকে আবিষ্কৃত করেন এবং একটি মন্দির নির্মাণ করেন । মূর্তিটি ঢাকা ছিল বলে ঢাকেশ্বরী নামকরণ হয়।
আরেক প্রবাদ মতে, দেবী সতী দেহের একান্নটি খণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে যে সব স্থানে পড়েছিল সে স্থানগুলো এক একটি পীঠস্থানে পরিণত হয়। সতী দেহ ছিন্ন হওয়ার পর তাঁর কিরিটের ডাক (উজ্জ্বল গহনার অংশ) এই স্থানে পড়েছিল। তাই এটা উপপীঠ। সেই ডাক থেকেই ঢাকেশ্বরী নামের উৎপত্তি হয়। যতীন্দ্রমোহন রায় তার ঢাকা জেলার ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন: ভবিষ্য ব্রহ্মখন্ডে বলা হয়েছে যে
বৃদ্ধ গঙ্গাতটে বেদ বর্ষ সাহস্র ব্যত্যয়ে
স্থাপিতব্যঞ্চ যবনৈ জাঙ্গিরং পতনং মহৎ।
তত্র দেবী মহাকালী ঢক্কা বাদ্যপ্রিয়া সদাঃ
গাস্যন্তি পত্তনং ঢক্কা সজ্ঞকং দেশবাসিনঃ।
মানসিংহ ১৫৯৪-১৬০৬ সাল পর্যন্ত তিন দফায় বাংলার সুবেদার থাকাকালে মন্দিরটির জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে এটির সংস্কারের ব্যবস্থা করেন। এসময় তিনি মন্দির প্রাঙ্গণে ৪টি শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন ও তার পাশাপাশি চারটি শিবমন্দিরও নির্মাণ করেন। তবে মানসিংহই মন্দিটির সংস্কার করেছিলেন এমন সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এফ বি ব্রাডলী বার্ট ১৯০৬ সালে তাঁর রোমান্স অব এ্যান ইস্টার্ণ ক্যাপিটেল নামক গ্রন্থে লিখেছেন- “বর্তমান মন্দিরটি ২০০ বছরের পুরনো ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক হিন্দু এজেন্ট এটি নির্মাণ করেন।”
এই মন্দিরের দেবী ঢাকেশ্বরীর আসল ৮০০ বছরের পুরোনো বিগ্রহটি কলকাতার কুমারটুলি অঞ্চলে দুর্গাচারণ স্ট্রিটের শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দিরে রয়েছে। দেশ ভাগের সময় ঢাকা থেকে কলকাতায় এটিকে আনা হয়। দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গার সময় সম্ভাব্য আক্রমণ এবং লুন্ঠনের হাত থেকে দেবীকে রক্ষা করতে ঢাকার মূল বিগ্রহটিকে গোপনে এবং দ্রুততার সঙ্গে ১৯৪৮-এ কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন রাজেন্দ্রকিশোর তিওয়ারি (মতান্তরে প্রহ্লাদকিশোর তিওয়ারি) এবং হরিহর চক্রবর্তী। বিশেষ একটি বিমানে ঢাকেশ্বরী আসল বিগ্রহটি কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। কলকাতায় বিগ্রহটি আনার পর প্রথম দু’বছর হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটে দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরির বাড়িতে দেবী পূজিতা হন। পরে ১৯৫০ নাগাদ ব্যাবসায়ী দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরী কুমারটুলি অঞ্চলে দেবীর মন্দির নির্মাণ করে দেন ও প্রতিষ্ঠা করে দেবীর নিত্য সেবার জন্য কিছু দেবোত্তর সম্পত্তি দান করেছিলেন। মূল দেবী বিগ্রহের উচ্চতা দেড় ফুটের মতো, দেবীর দশ হাত, কাত্যায়নী মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা রূপেই তিনি অবস্থান করছেন। পাশে লক্ষী, সরস্বতী ও নিচে কার্তিক ও গণেশ। বাহন রূপে পশুরাজ সিংহ দন্ডায়মান যার ওপর দাঁড়িয়ে দেবী মহিষাসুরকে বধ করেছেন। মানসিংহ এই বিগ্রহ ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করে আজমগড়ের এক তিওয়ারি পরিবারকে সেবায়েত নিযুক্ত করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে সেই পরিবারের বংশধরেরাই কলকাতায় এসে পুনরায় সেবায়েত নিযুক্ত হন, এখনো তারাই দেবীর নিত্য সেবা করেন।
বর্তমানে ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে থাকা বিগ্রহটি মূল মূর্তির প্রতিরূপ। এখানে প্রতি বছর ধুমধামের সাথে দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
বিগত ১০ নভেম্বর ২০১৮ আর টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের এক সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলেন যে ২০ বিঘা জমির মধ্যে আমরা পাঁচ বিঘার কিছু বেশি জমি ভোগ করছিলাম। এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আরও দেড় বিঘা পেলাম। সেখান থেকে বিভিন্ন স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিমের দেড় বিঘা জমি আমরা ফিরে পেয়েছি। এখন মন্দিরের মোট জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.১ বিঘা।’
অবশিষ্ট ১৩.৯ বিঘা জমি ফিরে পেতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথাও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘মন্দিরের ভূমি সমস্যা নিয়ে ১৯৬৩ সালে দায়ের হওয়া এক মামলার কার্যক্রম চলছে এখনও। নাভানা গ্রুপের দখলে থাকা দুই বিঘা জমি ছাড়াও পাকিস্তান আমলে মমিন মোটরসের দখলে থাকা তিন বিঘা জমি নিয়ে মামলা নিয়ে লড়াই করছে পূজা উদযাপন পরিষদ।’
ঢাকেশ্বরী দেবীর প্রতিমা যেখানে স্থাপিত সেসব জায়গা ঘিরে ভাওয়াল রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় বাহাদুরের আমলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জন্য ২০ বিঘা জমি দেবোত্তর ভূমি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়। দেশে আনুষ্ঠানিক ভূমি জরিপ শুরু হলে মন্দিরের পুরো জায়গা দেবোত্তর ভূমি হিসেবে ঢাকাস্থ মৌজায় সিএস ৩০ থেকে ৪৩ নম্বর দাগে রেকর্ডভুক্ত হয় এবং নকশায় স্পষ্ট করে পাকা পিলারসহ সীমানা নির্ধারণ করা হয়। এরপর পাকিস্তান আমলে অনুষ্ঠিত এসএ জরিপে লালবাগস্থ মৌজায় ৯৪-৯৭ ও ১০১-১১৭ নং দাগগুলো এসএ রেকর্ডভুক্ত হয়।