Wednesday, April 24, 2024
ব্লগ

বিস্ময়ের এক নাম দেবস্মিতা

নাম দেবস্মিতা নাথ। মায়ের নাম সুমিতা নাথ। বাবা দেবাশিস নাথ। জন্ম ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল পচিম বর্ধমান জেলার দূর্গাপুরে। জন্ম থেকেই দেবস্মিতা সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্ৰান্ত। রোগটি হল ইম ম্যাচুরিটি অফ ব্রেন। বিকাশ খুব দেরীতে ঘটে। ফলে অন্যান্য অঙ্গের সঞ্চালন খুব দেরি করে হয়। এই রোগটি কোনো দিন পুরোপুরি সারবে না। তাই ডাক্তার বাবুরা ওকে হোপে দিতে বলেন। কিন্তু মা ও বাবার অদম্য জেদ ও পরিশ্রমের ফলে দেবস্মিতা একটু একটু করে সুস্থ হতে শুরু করে।

প্রথমে ফিজিও থেরাপি, তারপর সাঁতার, অঙ্কন, ও শিল্পের সমস্ত দিকে ওকে দেখিয়ে ও কোনদিকে সাড়া দিচ্ছে সেটা দেখতে চেয়েছিলো ওর বাবা মা। ও এক বছর বয়সে হামা দিতে শেখে। তিন বছর বয়সে দেবস্মিতা কে একটি জেনারেল স্কুলে ভর্তি করা হয় কিন্তু স্কুল জীবন একেবারে ভালো ছিল না। তখনও হাঁটতে পারে না। প্রতিনিয়ত অপমান ও অবজ্ঞার সাথে জীবন কাটছিলো। তারপর আস্তে আস্তে মেয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়াতে শুরু করলো। কিন্তু অবলম্বন ছাড়া তখনও হাটতে পারতোনা। এখনো পারেনা। তার অবলম্বন হলো মা।

দেবস্মিতা নাথ- মনন সাহিত্য পত্রিকা থেকে সম্মানিত

সাড়ে তিন বছর বয়সে ও কথা বলতে শিখলো। বাবা, মা তারপর ছোটো ছোটো শব্দ, কথা অবশেষে কবিতা। এই ভাবে দিন চলছিল। পড়াশোনা চলছিল। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের শেখানো কবিতা অন্য স্কুলে বলে দ্বিতীয় পুরস্কার নিয়ে এলো। কবিতা জীবনে প্রথম জয়। এই সূত্র ধরে একজন শিক্ষিকার কাছে কবিতা শেখা শুরু। তাঁর হাত ধরে বিভিন্ন স্কুলে প্রতিযোগীতা দিযে পুরস্কার অর্জন, প্রচুর অনুষ্ঠান করা রবীন্দ্র, নজরুল জয়ন্তী ইত্যাদি অনুষ্ঠানে।

এসব করে নিজের একটা ভালো পরিচিতি তৈরি করেছিল। প্রচুর পুরস্কারের মধ্যে সব থেকে বড় হলো মাত্র ১৫ বছর বয়সে সারা বাংলা আবৃত্তি প্রতিযোগীতাতে প্রথমপুরস্কারর দ্বিতীয় হলো। নয় বছর বয়সে রাজ্য স্তরের প্রতিযোগীতায় প্রথম হওয়া, তাছাড়া বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠান করে ভালো পরিচিতি করে ফেলেছিলো। কিন্তু মেয়ের এই সাফল্য স্কুল জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। স্কুলে ব্যাপার টা জানাজানি হওয়া মাত্র ওর উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু হয়ে গেলো। ফল সরূপ ৪টি স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল।

প্রাক্তন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেবস্মিতা

এদিকে মেয়ের যখন মাত্র ১৩ বছর বয়স তখন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওয়ার্ক শপ করে তারপর ব্রততী পরম্পরায় এবং সবশেষে ওনার প্রতিষ্ঠানে শেখার সুযোগ পায়। সেই সময় প্রদীপ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ বসু, উর্মিমালা বসু প্রমুখ ব্যাক্তিত্বদের কাছে তালিম পায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সে দেবস্মিতার সিডি তৈরী হয়ে যায়। তবে প্রতিবন্ধী হওয়ার দরুণ সিডি বানাতে গিয়েও অনেক সিডি কোম্পানীর কাছে বেগ পেতে হয়, অপমানিত হতে হয়। তখন ভাবনা রেকর্ডস সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়। ১৭ বছর বয়সে কোলকাতাতে প্রথম অনুষ্ঠান করে সুজাতা সদনে, তারপর রবীন্দ্র সদনে এবং কোলকাতার নামী মঞ্চ গুলিতে, এখনো করছে।

সারা বাংলা আবৃত্তি প্রতিযোগীতা প্রথম ১৫ বছর বয়সে

মাত্র ১৬ বছর বয়সে দেবস্মিতা কবিতা শিখিয়ে প্রথম রোজগার শুরু করে ১৫০ টাকা নিয়ে। তারপর বিভিন্ন কোম্পানীর অ্যাডে ভয়েস দেওয়া শুরু করে এবং ভালো রোজগার করে। সেই সব অর্থ ও বিভিন্ন স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠান করে যে অর্থ উপার্জন করেছিল সেগুলি করোনাকালীন সময়ে বাবার হাতে তুলে দেয় দুস্থদের সাহায্য করার জন্য। ১৮ বছরের শুরুতে ভাব্না রেকর্ডস থেকে প্রথম সিডি টি রিলিজ হয় কোলকাতা প্রেস ক্লাবে এবং মাত্র ২০ বছর বয়সে শ্রদ্ধার্ঘ্য নামে দ্বিতীয় সিডি প্রকাশিত হয় একই জায়গা থেকে।

প্রথম সিডি রিলিজের আগে গুরুর সাথে

দেবস্মিতা মাত্র ২০ বছরের জীবনে বহু সম্মান পায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৮ বছর বয়সে ইন্ডিয়ান ফটো লাভার্স এন্ড কালচারাল ফাউন্ডেশন থেকে কনিষ্ঠ তম বাচিক শিল্পী হিসাবে পঞ্চম বর্ষ বঙ্গ প্রমীলা সম্মান, এটি একটি জাতীয় স্তরের সম্মান,
মনন সাহিত্য পত্রিকা থেকে কনিষ্ঠ তম বাচিক শিল্পী সম্মান। সিন্ধুরা একাডেমী, কোলকাতা সমাজবার্তা নিউস, নাদিয়া ডিজিটাল মিডিয়া এসোসিয়েশন সম্মান পায় দেবস্মিতা। আনন্দ মুখর সাহিত্য পত্রিকা ও পরিষদ থেকে কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি স্মারক সম্মান, বিস্ব বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মান ইত্যদি সম্মান পায়। এছাড়া বিভিন্ন এফ এম ও কোলকাতা আকাশবাণীতেও অনেকবার অনুষ্ঠান করেছে এবং করছেও।

পঞ্চম বর্ষ বঙ্গ প্রমীলা কৃতিরত্ন সম্মান

এখন দেবস্মিতার বয়স ২০ বছর। ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশ অনার্স নিয়ে পড়ছে। নিজের পড়াশোনা ও কবিতা সামলে প্রতি রবিবার আর্থ সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া বাচ্ছাদের পড়ায় ও কবিতা শেখায় বিনা পয়সায়।

আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া বাচ্ছাদের পড়ানো ও কবিতা শেখাচ্ছে দেবস্মিতা

ওর ইচ্ছে ওর মতো যারা সমাজে অবহেলিত তাদের কাছে নিজেকে দৃষ্টান্ত তৈরী করা এবং তাদের জন্য কিছু করা। কবিতাকে পাথেয় করে বিশ্বের দরবারে নিজের একটা জায়গা করে নেওয়া। আগে কবিতা নেশা ছিল এখন পেশাও।

লেখিকা: সুমিতা নাথ (দেবস্মিতার মা)