Saturday, April 20, 2024
সম্পাদকীয়

আলোচনায় ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভোর’

————————————————————————–
দেবরাজ ভট্টাচার্য

=========

১। শ্রুত সাহিত্য মূলত দুটি ধারায় প্রবহমান। একাধারে থাকে তার আদি নির্মাণের চিহ্ন যা কালের অনাহুত গহ্বরে নিমজ্জিত,কখনো ধূলিমলিন পাতায় আবছা হয়ে আসা দাগের মতো; অন্যধারে প্রতি মুহূর্তে নতুন করে গড়ে ওঠা একটি নীরব বয়ান যা শ্রোতার অন্তর থেকে ক্রমশ ছড়িয়ে যায় সভ্যতার সমষ্টিগত চেতনায়।

মহালয়ার শারদ প্রাতে বেজে ওঠা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সৃষ্টির একটি হারিয়ে যাওয়া ইতিবৃত্ত আছে। আর আছে তিনটে পাঠ। অর্থাৎ যাকে আমরা বলবো তিনটি ম্যানুস্ক্রিপ্ট। যদিও সবকটি লিখিত বয়ানে পাওয়া যায়না। কিছু ক্ষেত্রে পাঠ গড়ে উঠেছে স্টুডিও সম্পাদনার ভিত্তিতে। যেমন ২০১৬ পূর্ববর্তী কালে আকাশবাণী যে ‘বহুশ্রুত’ পাঠটি বেতারে প্রচার করতেন সেটির শুরুতে ‘যা চন্ডী’ ছিল ‘সমবেত কণ্ঠের সংগীত’। বর্তমানে যেটি শোনা যায় তাতে রয়েছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের একক কন্ঠ। অর্থাৎ যে মহিষাসুরমর্দিনী বেতারে প্রচারিত হয় তার গড়ে ওঠার একটি নানামাত্রিক ইতিহাস রয়েছে। রয়েছে সম্পাদনার আঁচড়ে বার বার বদলে যাওয়া তরঙ্গায়িত ইথার যার পরিচয় অমীমাংসিত।

তদাপি, মহিষাসুরমর্দিনীর একটি ছবি আমরা বয়ে বেড়াই। শুভ আর অশুভের ভোঁতা বর্শীর ঘায়ে এক বছর অপেক্ষা করে থাকি কারণ ক্ষতবিক্ষত সমাজে আর কোথাও সত্যের জয় হোক বা না হোক, মহালয়ার শারদপ্রাতে হবেই। নিয়ত জীবনের লড়াইয়ে হেরে গিয়েও এইই আমাদের জিতে যাওয়া। দেবতারাও এমনটাই ভেবেছিলেন যখন দেবী অসুর নিধন করলেন।
শ্রীমৎ অনির্বান লিখছেন-

‘শিব পরম বৈরাগী। কিন্তু তাঁকেই অবলম্বন করে বিশ্বপ্রকৃতির লীলা চলছে। সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে মহাপ্রকৃতি তার কোলে বসেছে। রিক্ততা এবং পূর্ণতা পাশাপাশি। আমাদের শক্তি পূজাতেও এই ইতি এবং নেতির ধারাটি সুন্দর করে দেখান আছে। শক্তি আমাদের ভিতর ফুটছে- প্রথমে সে ‘নন্দা’, এটা তার বালিকাবস্থা। তখন সে উচ্ছল আনন্দময়ী। তার পরে ‘নন্দা’ শক্তির ভিতরে দেখা দেয় ‘ভদ্রা’, কল্যাণময়ী। এটা কিশোরী অবস্থা। তারপরে আসে তারুণ্য- এখানে সব বিরোধী শক্তি দেখা দেয়। বিরোধী শক্তিকে জয় করতে হবে, তখন যে রূপটি ফুটল তা হলো ‘জয়া’। তারপরে সে শক্তি নিঃস্ব হয়ে যায়। তখন সে হয় ‘রিক্তা’। দুর্গাৎসবে এই ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়। ষষ্ঠীতে সে ‘নন্দা’, সপ্তমীতে সে ‘ভদ্রা’, অষ্টমীতে সে ‘জয়া’ মহিষাসুরমর্দিনী; নবমীতে ‘রিক্তা’ শূন্যা-লব্ধ জয়কে সে প্রত্যাখ্যান করে। অষ্টমী আর নবমীর মাঝখানে সন্ধিপূজা আছে, গভীর রাত্রিতে সে পূজা হয়। জয়লাভ করে, সিদ্ধি পেয়ে, সব সমর্পণ করে শূন্য হয়ে যাওয়া। নবমীর বলি তাই পরিপূর্ণ আত্মোৎসর্গের সৃচক। এরই ইঙ্গিত দেওয়া আছে কেনোপনিষদের উপাখ্যানে (৩।১)। সেখানে বলা হয়েছে ‘ব্রহ্ম হ দেবেভ্যো বিজিগ্যে, তস্য হ ব্রহ্মণো বিজয়ে দেবা অমহীয়ন্ত। ত ঐক্ষন্তাস্মাকমেবায়ং বিজয়োহস্মাকমেবায়ং মহিমেতি’। ব্রহ্মই জয়লাভ করলেন আর দেবতারা সে জয়ে মহিমান্বিত হলেন। কিন্তু দেবতাদের অভিমান হল জয়লাভ আমরা করেছি, এর মহিমা আমাদের । তখন তাঁদের অভিমান দূর করবার জন্য ব্রহ্ম যক্ষ রূপে (mystery) রহস্যমূর্তিতে তাঁদের সামনে প্রকট হলেন। দেবতারা প্রথমে অগ্নি ও বায়ুকে পাঠান। কিন্তু তারা পরাভূত হয়ে ফিরে আসে। তখন দেবতারা ইন্দ্রকে পাঠান। ইন্দ্রও প্রথম তাকে চিনতে পারলেন না, আর তখন যক্ষের জায়গাতে একটা মহাশূন্য দেখা দিল। আর সেই মহাশূন্যে দেখা দিল একটি নারীমূর্তি, তিনি উমা হৈমবতী। তিনি ইন্দ্রকে ব্রহ্মের মহিমা বুঝিয়ে দিলেন। সর্ব প্রথম ইন্দ্রই ব্রহ্মের জ্ঞান পেলেন, তাই ইন্দ্র দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ইন্দ্রচেতনা যখন শূন্য হল তখনই সে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে পারল! সাধনার বেলায় এই একই কথা খাটে । যখন কোনো সিদ্ধি লাভ করি তখন যদি মনে করি এ বিজয় আমাদের, তখন দেবতা তা সহ্য করেন না। তাঁর কাছে আবার আমাদের পরাভব মানতে হয়। তখন সব সমর্পণ করে রিক্ত হতে হয়। তারপরে আবার ঐশ্বর্য ইত্যাদি ফিরে পাই পূর্ণরূপে যথার্থভাবে’।

২। সাহিত্যের আলোচনায় টেক্সট নির্বাচনের সীমাবদ্ধতার মাঝেই প্রচলিত ডিসকোর্সের প্রতিস্পর্ধী একটি গবেষণা ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভোর’। প্রতিস্পর্ধী এই কারণেই যে মহিষাসুরমর্দিনীর প্রচারিত তিনটি বেতার তরঙ্গস্রোতের সবকটির লিখিত বয়ান নেই। অথচ তিনটি স্রোত ক্যাসেটের থেকে দর্শকের কানে পৌঁছানোর আগে পেরিয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকটি স্টুডিও সম্পাদনার পর্যায়। যাতে বদলেছে পারম্পর্য, শোনা গেছে নতুন সুরের কাঠামো। ফলত পাঠান্তরের মধ্যে দিয়ে যখন গবেষক একটি মান্য পাঠ তৈরি করতে চেয়েছেন তখন শ্রুত পাঠকেই ধরে নিতে হয়েছে টেক্সট রূপে। একদিকে কিছু লিখিত জীর্ন বয়ান, অন্যদিকে বেতারের রেকর্ডিং, এই দুইয়ের মধ্যে দিয়ে গবেষক তৈরি করেছেন মহিষাসুরমর্দিনীর একমাত্র মান্য টেক্সট। উল্লেখ্য, এখানে লেখক নয়, গবেষক শব্দটি সচেতন ভাবেই প্রয়োগ করা হয়েছে।
শ্রুত থেকে লিখিত বয়ান তৈরির অনেকগুলি সমস্যা রয়েছে। কখনো সুরের আদরে শব্দের মাধ্যাকর্ষণ হ্রাস পায়। আবার কখনো সম্পাদনায় হারিয়ে যায় শব্দের চেহারা। ফলে এক্ষেত্রে শ্লোকের উৎস খুঁজে তার প্রকৃত পাঠ চিহ্নিত করা দীর্ঘ শ্রমসাধ্য কাজ। যে শ্রমের ফসল বইটির প্রতিটি পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে অকাতরে।
বইটি যেমন একদিকে ঐতিহ্য নির্মাণের ইতিহাস, তেমনি গবেষণা প্রকরণের একটি নতুন মান্য দলিল। যে প্রকরণ শ্রুত-কে সাহিত্যের অনায়াস চলনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। বদলে যাওয়া সুর আর কথকের উচ্চারণকে বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই পাওয়া গেছে স্পষ্ট ভাষ্য।

৩। ভালো এবং খারাপের দ্বান্দ্বিক লড়াইয়ে গড়ে ওঠে ব্যক্তিত্ব। আর ব্যক্তিগত মানুষ তার রিডেমশনের চেতন থেকে গড়ে তোলে সমষ্টিগত মূল্যবোধ মূলক আচরণ। রাবণ বধ আসলেই নিজের মধ্যে থাকা রাবণের দশটি মাথাকে হত্যা করা অর্থাৎ দশটি ইমোশনকে স্বীকার করা। স্বীকারের একটি সচেতন উপলব্ধি আছে। যা হয়ে ওঠাকে প্রভাবিত করে। আমরা তো প্রতিদিন ভেঙে গিয়ে নতুন করে গড়ে তুলি নিজেকে। রাবণ ব্রাহ্মণের সন্তান অথচ ওই দশটি ইমোশন যা হল অহংকার, মোহ, অনুতাপ, ক্রোধ, ঘৃণা, ভয়, হিংসা, লোভ, কাম এবং, জড়তা তাঁর আত্মজ্ঞানের পথে অন্তরায়। রাবণকে হত্যা করে নয়, কারণ লক্ষ করবেন রাবণের ধনুর্বানের আঘাতে প্রতিটি মাথা হত্যার পর পুনরায় জন্ম নেয়, তাই তাকে রিক্ত করেই তার ব্রহ্মজ্ঞানের পথ।
যাইহোক, একসময় বিতর্ক তৈরি হল যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ কায়স্থের ছেলে হয়ে চন্ডীপাঠ করবে! ‘উত্তরে নাকি নৃপেনবাবু সেদিন বলেছিলেন, ‘প্রোগ্রাম করবে তার আবার বামুন কায়েত কী হে? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? তা হলে এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে তারা তো অর্ধেক মুসলমান, তা হলে তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়।’
অন্যত্র অন্নদাশঙ্কর রায় লিখছেন-
‘মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মাৎসুও সাতো একজন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ও অধ্যাপক। সংস্কৃতও জানেন। তাঁর পত্নীও একজন বিদুষী মহিলা । স্বামীর চেয়ে ইংরেজীতে এক কাঠি সরেশ। আমরা তাঁদের বাড়ি গিয়ে দেখা করতেই সাতো বললেন, “এখনি আমাকে মন্দিরে যেতে হচ্ছে পৌরোহিত্য করতে। শরৎকালের এই অমাবস্যায় পিতৃপুরুষদের স্মরণ করতে হয়”।
তখন আমি মিলিয়ে দেখলুম যে ওই দিনটি আমাদের মহালয়া। বললুম, ‘আমাদেরও পিতৃপুরুষদের তর্পণ করতে হয় এই দিন’। আশ্চর্য। না? কোথায় জাপান আর কোথায় ভারত! পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা হয় একই তিথিতে। জাপান সরকার ওটিকে অন্য নামে ন্যাশনাল হলিডে করেছেন।’

‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভোর’ গ্রন্থে অধ্যাপক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কৃত মহিষাসুরমর্দিনীর মান্য পাঠকে আমরা আন্তর্জাতিক বলছি। নিৎসে তাঁর গ্রন্থ ‘দা বার্থ অফ ট্র্যাজেডি’তে বলছেন সংস্কৃতির জন্ম হয় সভ্যতার সংকীর্ণ অন্ধকার থেকে এবং এই সংস্কৃতি বারংবার আধুনিক মানুষকে তার আত্মধারণা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মহিষাসুরমর্দিনী একটি সংস্কৃতির নাম। যে সংস্কৃতি তর্পণ-এর ভোরের সূচনা করে। ফ্রয়েডীয় মতে মানুষের সমস্ত অনুভব অবদমিত অবস্থায় থাকে এবং অতীত থেকে অর্জিত অবচেতন আমাদের বিব্রত করে, বিরত করে, বিস্মিত করে। অতএব বর্তমান গ্রন্থের মান্য পাঠ শুধুই একটি পারফরমেন্স টেক্সট নয় বরং অর্ধশতাব্দীর অধিক জায়মান এবং অগণিত অতীতের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের পরিকাঠামো। যাকে কেন্দ্র করে উদ্বেলিত হয়েছে একাধিক জাতি, উৎসাহিত হয়েছে ধর্মীয় প্রবণতা, অজান্তেই সংঘাতে মেতে উঠেছে আমাদেরই ভালো আমি এবং খারাপ আমি।

৪। অন্তরের আলেখ্যের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে অন্য এক নির্মাণের স্মৃতি। যা থেকে আলেখ্যের অন্দরে তৈরি হয় অবাধ যাতায়াত। একটা সামুহিক বোধ তার উদযাপনের মধ্যে দিয়ে প্রভাবিত করতে থাকে পারিবেশিক চেতনাকে।
এই বইটি পড়া আসলে একটা পথচলা। সময়, মানুষ, শিল্প আর এদের মধ্যে পরস্পর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া জাত আত্মগত নির্যাস তৈরি হতে থাকে। তৈরি হয় গবেষণার ভিন্নতর পরিসর।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভোর
আলেখ্য অন্তরে ।। আলেখ্যের অন্দরে
লেখক: মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক: বীরুৎজাতীয়