Saturday, July 27, 2024
সম্পাদকীয়

১৯ শে মে – বাঙালির উপেক্ষিত ভাষা আন্দোলন

কলকাতা ট্রিবিউন ডেস্ক: পরের দিন ভোট, তার সাথে অনুষ্ঠানটি আবার গুরুগম্ভীর আলোচনার। রবিবারের দুপুরে অনুষ্ঠান আয়োজন করায় এটা মনেই হয়েছিল যে ভাতঘুম ছেড়ে এই গরমে কতজন আসবেন ? বিরতি বিহীন ২.৩০ ঘণ্টার প্যানেল ডিসকাশন কতটা জনপ্রিয় হবে সেটা নিয়ে আয়োজকদের মধ্যে দ্বিধা ছিল। নিট ফল – ৭০ আসন বিশিষ্ট হলের অনুষ্ঠানে রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন ৭৫ জন। এর মধ্যে ১৫ জন আসেননি, আবার ১২ জন রেজিস্ট্রেশন না করিয়েই চলে এসেছিলেন, অর্থাৎ মোট উপস্থিতি ৭২ জন। এবার ভাবুন ওই অনুপস্থিত ১৫ আর ভোট না থাকলে আরো কিছু লোক যদি আসতেন তাহলে কোথায় গিয়ে পৌঁছত অবস্থা ? তাহলে, বাঙ্গালী অবশ্যই জাগছে, চোখটা খুলছে।

গত ১৯ মে কলকাতার মানিকতলা সংলগ্ন রামমোহন হলে তৃতীয় তলায় রায়া দেবনাথ সভাগৃহে বাংলা ভাষার জন্য বাংলাভাষী ভারতীয়দের আন্দোলন কবে কোথায় কিভাবে হয়েছে সেটা নিয়ে একটা মনোজ্ঞ আলোচনা সভা হয়ে গেলো। বৈভবী শাম্ভাভী ফাউন্ডেশনের পরিচালনায় এবং নিও ন্যাশনালিস্ট ও ভয়েস অফ হিন্দুস্তান সংঘের সহযোগিতায় এই অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রখ্যাত লেখক শ্রী সোমেন সেনগুপ্ত। আলোচনায় ছিলেন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু জনজাতির উপর গবেষণামূলক গ্রন্থ ” Being Hindu In Bangladesh” গ্রন্থের রচয়িতা শ্রী অভিষেক বিশ্বাস, লেখক ও সমাজকর্মী ডক্টর ওসমান মল্লিক ও খ্যাতনামা লেখক শ্রী সৌগত বসু মহাশয়।


অনুষ্ঠানে বিরতিহীন ২.৩০ ঘণ্টায় বক্তারা যে বিষয়গুলি আলোচনা করেন সেগুলি হলো, বাংলা ভাষার জন্য ভারতীয় বাঙালির লড়াইয়ের সঠিক ইতিহাস জানতে গেলে প্রথমেই একুশে ফেব্রুয়ারির কৃত্রিম এবং অর্থহীন আবেগ থেকে বের হয়ে আসতে হবে, আমাদের মনে রাখতে হবে পাকিস্তান নামক একটি প্রতিবেশী দেশের গৃহযুদ্ধ কখনোই আমার ঐতিহ্য হতে পারে না বরং বাংলা ভাষার জন্য ভারতীয় বাঙালির লড়াই অনেক পুরনো। এই লড়াই উর্দুর বিরুদ্ধে বাঙালি করেছিল সেই ১৯৪০ সাল থেকেই। যে লড়াইয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির আহবানে সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে স্যার যদুনাথ সরকার, নীলরতন সরকার এবং আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সহ আরো অনেকে। তারপরে একবার নয় বারবার মানভূম থেকে আসামের শিলচর হয়ে সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে কখনো হিন্দির বিরুদ্ধে কখনো অসমীয়ার বিরুদ্ধে এবং কখনো উর্দুর বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাকে রক্ত দিয়ে লড়াই করতে হয়েছে।

১৯ মে দিনটি কেনো বাংলা ভাষার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ সেই আলোচনা হয় অনুষ্ঠানে। ১৯৬১ সালে এই দিনে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে শান্তিপূর্ণ মিছিলে উপর আসামের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের পুলিশের গুলিবর্ষণে তে বরাক উপত্যকায় শিলচর রেলস্টেশনে নিহত হন কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, সচিন্দ্রনাথ পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকলম পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। ১৬ বছরের কমলা ভট্টাচার্য পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম নারী শহীদ। এদিনের অনুষ্ঠানে মঞ্চে এই শহীদদের নাম সম্বলিত একটি পোস্টার রাখা হয় এবং কমলা দেবীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত এই বক্তৃতায় কমলা দেবীর ছবিতে মাল্যদান করা হয়। এটি একমাত্র ছবি যেটি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।।

দুর্ভাগ্যের ব্যাপার আধুনিক প্রজন্মের অনেকেই কমলা দেবীর নাম জানেন না। খুব সুনিপুণভাবে এই শহীদদের আত্মবলিদানের এই গৌরবময় ইতিহাস থেকে আমাদের ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। বদলে বাধ্য করা হয় যাতে আমরা ওই পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে একুশে ফেব্রুয়ারিতে কি হয়েছিল সেটাই মনে রাখি, আর তাই বাংলা মাধ্যমের সিলেবাসে কোনো চ্যাপ্টারে ১৯ মের উল্লেখ পাওয়া যায় না।

তবে শুধু কি ১৯ মে, এই বাংলা ভাষার জন্যে উর্দুর বিরুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে দারিভিটের তরতাজা যুবক রাজেশ তাপস, আমর তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থেই বা কতটুকু কি করতে পেরেছি।

বক্তৃতার পর একটি ছোট্ট প্রশ্ন উত্তর সেশন ছিল দর্শকদের সাথে বক্তাদের। সকল আগত দর্শকদের শ্রী সৌগত বসুর লেখা ” বাঙালির ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ১৯৪০-১৯৬১” বইটি উপহার দেওয়া হয়, তার সাথেই ১৯ মে ২০২৪ স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত এই আন্দোলন নিয়ে একটি রিপোর্ট ও প্রিন্ট আউট করে দেওয়া হয়।

ঘটনার ৬ দশকেরও বেশি সময় পরে সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতায় প্রথমবার “কমলা ভট্টাচার্য স্মারক আলোচনা হলো”, বাঙ্গালী বছরের পর বছর “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১ ফেব্রুয়ারি” পালন করেছে , দেখা যাক কবে ” আমার বোনের রক্তে রাঙানো ১৯ মে” পালন করে । মনে রাখতে হবে ডান চোখে গুলি গেলে ও মস্তিষ্ক চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়ে মৃত কমলার জন্যে মানবতার পূজারী হিসাবে দাবী করা কংগ্রেসের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী জহরলাল নেহেরু ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে নিজেদের ঘোষণা করা বাম দলগুলি কখনো এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি।

বাঙালিকে তার নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হবে, সেটা শুরু হলো সবে, এখনও অনেক পথ বাকি। অনুষ্ঠানের ভিডিও আমরা চ্যানেলে আপলোড করব, প্রবন্ধের পুস্তিকাটি কেউ পড়তে চাইলে যোগাযোগ করবেন, এত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, নিজের ইতিহাস পড়ুন ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করুন, সময় বেশি বাকি নেই।

লিখেছেন: সুমন কুমার দত্ত