বাংলাদেশের সুগন্ধা সতীপীঠে দেবীর নাসিকা পতিত হয়েছিল
সংগ্রাম দত্ত:
—————
দেবী সতীর দেহের ৫১ টি খন্ড-বিখন্ড দেহাংশ গুলি যে যে জায়গায় পতিত হয়েছিল, সেখানে গড়ে উঠেছিল এক একটি তীর্থস্থান, সেই স্হানগুলো শক্তিপীঠ বা সতী পীঠ সনাতন ধর্মালম্বীদের কাছে পরিচিত।
এই ৫১ টি শক্তি পীঠের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম শক্তিপীঠ হল সুগন্ধা শক্তিপীঠ। বাংলাদেশের বরিশালের ১০ মাইল উত্তরে শিকারপুর গ্রামে সুগন্ধা শক্তিপীঠ অবস্থিত। এই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এ মন্দিরটি শক্তিপীঠ সমূহের মধ্যে অন্যতম বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশের বরিশাল জেলা শহরের দশ মাইল উত্তরে শিকারপুর গ্রামে অবস্থিত। এখানকার ভৈরব ত্রয়মবক, যার মন্দিরটি ঝালকাঠি জেলা শহর থেকে ৫ মাইল দক্ষিনে পোনাবালিয়ায় অবস্থিত।
পোলাবালিয়া সুগন্ধা নদীর তীরে অবস্থিত সামরাইল গ্রামের অন্তর্গত। হিন্দু ভক্তদের জন্য এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থানও বলা যায়।এখানকার প্রধান উৎসব হল শিব চতুর্দশী।
কাহিনী মতে মহাযোগী স্বামী দয়ানন্দ অবধূত এই পোনাবালিয়ার ভৈরব মন্দিরে কঠোর শিব সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। বর্তমানে এই ভৈরব মন্দিরটি শিববাড়ি নামে বিখ্যাত এবং শৈব অবধূতমার্গীগণের মিলনক্ষেত্র হিসেবেও পরিচিত।
সত্য যুগে দক্ষযজ্ঞের পর সতী মাতা দেহত্যাগ করলে মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করেছিলেন। তখন উপায় না দেখে ভগবান বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর মৃতদেহ খন্ড খন্ড করেছিলেন।
এর ফলে সতী মাতার দেহ খণ্ড গুলি ভারতীয় উপমহাদেশ এর বিভিন্ন জায়গায় পড়েছিল এবং এই সমস্ত জায়গা গুলি শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিতি পায়।
বাংলাদেশের সুগন্ধা শক্তি পীঠে দেবী জগদম্বা সতী দেবীর নাসিকা (নাক) পতিত হয়েছিল। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যতে এই শক্তিপীঠের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। শিবচরীতেও পীঠ নির্ণয়তন্ত্রে এই সতী পীঠের কথা উল্লেখ আছে।
কোন তীর্থস্থান গড়ে ওঠার পেছনে থাকে অনেক ইতিহাস। নদীমাতৃক বাংলাদেশে একসময় পোনা বালিয়া ও সামরাইল গ্রামের পাশ দিয়ে পবিত্র সুগন্ধা নদী প্রবাহিত ছিল । কিন্তু কালের করাল গ্রাসে আজ আর সেই নদী দেখাই যায় না। তার স্রোত হারিয়ে ক্ষীন স্রোত হয়েছে, যার নাম সোন্ধ।
কিন্তু দেবী সতী এখনো সুগন্ধা নদীর পূর্ব পাড়ে দেবিপীঠ, পশ্চিম পাড়ে দেবীর ভৈরব স্তম্বকেশ্বর বিরাজমান । একসময় এখানে গভীর জঙ্গল ছিল। যেখানে দিনের বেলাতেও কোন লোকজনেরই দেখা যেত না। কোন মানুষজন সেখানে যেতে ভয় পেতেন।
সেই সময় শিকারপুরের খুব ধনী জমিদার শ্রীরাম রায় একদিন স্বপ্নে মহাদেবের আদেশ পেলেন। সেই আদেশে মহাদেব তাঁকে জানান যে, “তোমার রাজত্বের সামরাইল এর জঙ্গলে একটি ঢিপির মধ্যে আমি অবস্থান করছি। তুমি সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করো, তাহলে তোমার মঙ্গল হবে”।
দৈব আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা কারো নেই। তাই স্বপ্ন দেখা মাত্রই পরের দিন জমিদার রাম রায় প্রচুর লোকজন নিয়ে সেই জঙ্গলে তল্লাশি শুরু করেন। এমন সময় জঙ্গলে কিছু রাখাল বালক গরু চড়াচ্ছিল, অত লোকজন আর পাইক-পেয়াদা দেখে রাখাল বালকরা ভয় পেয়ে পালাতে গেলে জমিদার রাম রায় তাদেরকে সাহস দিয়ে বলেন যে, “আমাকে দেখে ভয় পেয়ো না তোমরা, আমি এখানে জঙ্গলের মধ্যে কেবলমাত্র একটি অলৌকিক ঢিপির খোঁজ করতে এসেছি”। তখন রাখাল বালকরা এইরকম একটা অলৌকীক ঢিপির সন্ধান জানতো ।
সেই রাখাল বালকরা যে ঘটনাটি জানত, সেই ঘটনা বলতে শুরু করে। রাখালদের গরুগুলো আগের মত আর দুধ দেয় না। গরুর মালিক ভাবল রাখালরা হয়তো সেই দুধ চুরি করতো গরু চড়ানোর সময়। একদিন গরুর মালিক ভাবল হাতেনাতে চোরগুলোকে ধরবে। তারপর রাজার কাছে নালিশ জানাবে।
এই ভেবে একদিন মালিক রাখালদের পিছু নিয়েছিল। চুপি চুপি জঙ্গলে যায়। গরুগুলো যখন ঘাস খাচ্ছিল, মালিক তখন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ মালিক দেখলো গরুগুলো একে একে জঙ্গলে ঢুকে একটা উঁচু ঢিপিতে নিজেরাই তাদের দুধের বাঁট থেকে দুধ দিচ্ছে।
মালিক তখন হতভম্ব হয়ে ভাবতে শুরু করে যে, গরু গুলো এমন কেন করছে ! ওই ঢিপিতে কি এমন আছে ? এই ভেবে মালিক নিজে জঙ্গলের শুকনো কাঠ খড় জোগাড় করে ওই ঢিপিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। যখন দাউ দাউ করে আগুনের শিখা জ্বলতে শুরু করে তখন মালিক দেখল যে একটি কৃষ্ণ বর্ণের বালিকা সেই ঢিপি থেকে দৌড়ে পাশের জলাশয় প্রবেশ করে।
রাখালদের কাছে এই শুনে জমিদার রাম রায় সেই ঢিপির কাছে পৌঁছে খনন কাজ এর আদেশ দিলেন। খনন করতে করতে লিঙ্গ মূর্তি বের হল। তিনি ভাবলেন যে, এই লিঙ্গ তিনি গৃহের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে প্রতিনিয়ত সেবা করবেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, কত শত লোক মিলেও সেই লিঙ্গটি তুলতে সক্ষম হলো না। সেই দিন রাতে মহাদেব আবার রাজাকে স্বপ্নে বললেন যে, “আমাকে ঐখানেই প্রতিষ্ঠা কর, মনে রাখবে আমার বিহারের স্থানে কোন আচ্ছাদন থাকবে না”। সেই ভাবেই শিবকে স্থাপন করে নিত্য পূজার ব্যবস্থা করলেন।
আরেকটি ঘটনা অনুসারে জানা যায় যে, শিকারপুর গ্রামে পঞ্চানন চক্রবর্তী নামে একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন সৎ, ধার্মিক আর মানব প্রেমিক। একসময় স্বপ্নতে তিনি মা কালীকে দেখতে পেলেন। তিনি বললেন যে, “সুগন্ধার গর্ভে আমি শিলা রূপে বিরাজিত আছি, তুমি আমাকে সেখান থেকে তুলে এনে প্রতিষ্ঠা করো, এবং পূজার ব্যবস্থা করো”।
ব্রাহ্মণ চক্রবর্তী সেই স্বপ্নের আদেশ অনুযায়ী দেখানো জায়গাতে গিয়ে দেখেন সেখানে মায়ের মূর্তি। সেটি তুলে প্রতিষ্ঠা করা ও নিত্য পূজা করার ব্যবস্থা করলেন গ্রামের লোকজনসহ। গ্রামের সকলে এসে যে যেমনটা পারতো তেমন ভাবেই মায়ের সেবা করতে লাগলো।
কিন্তু এখানে দেবীর যে আসল মূর্তি ছিল সেটা চুরি হয়ে যায়। তবে সতী মায়ের প্রস্তরীভূত দেবী অংশ এখানে কোথায় তা কেউই আজও জানেন না। বর্তমানে সেখানে দেবী উগ্রতারার মূর্তি হিসেবে বিরাজমান। তাঁকেই দেবী সুগন্ধা রূপে পূজা করা হয় । এখানে দেবী খড়গ, খেটক, নীল পদ্ম, নর মুন্ডের কঙ্কাল ধারণ করে আছেন। মাথার উপরে বিরাজ করছেন কার্তিক, ব্রহ্মা-বিষ্ণু, শিব, গনেশ।
এছাড়া এই মূর্তি বৌদ্ধ তন্ত্রের উগ্রতারার। এটা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ভারতবর্ষের বঙ্গদেশে প্রাচীনকাল থেকেই তন্ত্র সাধনার ব্যাপক হারে প্রচার ছিল। বাংলায় অনেক প্রাচীন কালী মন্দির রয়েছে। দেবী মন্দিরও দেখা যায়। বাংলায় শক্তির সাধনা হতো অনেক আগে থেকেই।
সুগন্ধা শক্তি পীঠের দেবীর প্রাচীন মন্দির বর্তমানে এখন আর নেই। এখন যেটা আছে সেটা হল নবনির্মিত। বৌদ্ধতন্ত্রে তারা (মা কালী) সাধনার বিশেষ প্রণালী দেখা যায়, এখানে সেই মতেই তারা মায়ের উপাসনা করা হয় এই মন্দিরে।
এখানো সতী দেবীকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নিষ্ঠা ভরে পূজা, ভক্তি ও উপাসনা করে আসছেন।