শ্রীকৃষ্ণের গায়ত্রী উপাসনা
কলকাতা ট্রিবিউন ডেস্ক: বর্তমানে অনেক ব্যক্তিই প্রচণ্ড সন্দিগ্ধ হয়ে যান যে, তিনি যদি কোনো গুরু থেকে দীক্ষা গ্রহণ না করেন, তবে তার কী গতি হবে বা কী মন্ত্র জপ করতে হবে ইত্যাদি। যারা বিভিন্ন গুরুদের থেকে দীক্ষা নিয়েছেন তাদের প্রসঙ্গ ভিন্ন। কিন্তু যারা কোনো বিশেষ মতাদর্শে দীক্ষিত না হয়ে, কোনো পবিত্র মন্ত্র সর্বদা জপ করতে চান তারা শাস্ত্রের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করলেই দেখতে পাবেন সেখানে সুস্পষ্টভাবে কোনো মন্ত্র জপ করতে হবে তা বর্ণিত হয়েছে। সেই পবিত্র মন্ত্রটি হলো বেদের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র ‘গায়ত্রী মন্ত্র’।
ॐ ভূর্ভুবঃ স্বঃ
তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি।
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা : ৩.৬২.১০)
‘সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়কর্তা; প্রাণস্বরূপ, দুঃখনাশক এবং স্বর্গীয় সুখস্বরূপ; জ্যোতির্ময়, সর্বরক্ষক বরণীয়, ঐশ্বর্যযুক্ত পরমাত্মার ধ্যান করি। সেই বরণীয় প্রেরণকর্তা যেন আমাদের বুদ্ধিকে শুভ কার্যে প্রেরণ করেন।’
জগতের সকলের মন্ত্র যেন এক হয়। এই প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের সর্বশেষ ‘সংজ্ঞানসূক্ত’-এ বলা হয়েছে—
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বো হবিষা জুহোমি।।
(ঋগ্বেদ : ১০.১৯১.৩)
‘তোমাদের সকলের মিলনের মন্ত্র এক হোক, মিলনভূমি এক হোক এবং মনসহ চিত্ত এক হোক। তোমরা একতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে অগ্রগামী হও। তোমাদের দেওয়া খাদ্য-পানীয় ঐক্যবদ্ধভাবে সুষম বণ্টন করে গ্রহণ কর।’
‘সমানো মন্ত্রঃ’—এই বাক্যে ঈশ্বর নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের সকলের মন্ত্র যেন এক হয়। বেদ, রামায়ণ, মহাভারতসহ যে মন্ত্রটি সর্বক্ষেত্রে ব্যবহৃত, তা হলো-ওঙ্কার (ॐ)। এই পবিত্র ওঙ্কার মন্ত্রই গায়ত্রী মন্ত্রের সাথে সংযুক্ত করে গায়ত্রীসন্ধ্যায় নিত্য জপ করতে হয়।
আমরা যে যে মত-পথের সম্প্রদায়ভুক্ত হই না কেন, আমাদের সবারই বৈদিক ওঙ্কার এবং গায়ত্রী মন্ত্রের শরণে আসা উচিত। তবেই আমরা ঋগ্বেদের ‘সংজ্ঞানসূক্ত’-এ ঈশ্বর নির্দেশিত সমান মন্ত্রভুক্ত হতে পারব। বিভিন্ন মত-পথের সম্প্রদায়গত মন্ত্রকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রেখে, আমাদের সবার উচিত ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী মন্ত্রের জপ করা।
বিভিন্ন মত-পথের সম্প্রদায়গত মন্ত্রকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রেখে, আমাদের সবার উচিত ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী মন্ত্রের জপ করা…
শ্রীমদ্ভবদ্গীতার মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, গীতযোগ্য শ্রুতির মধ্যে তিনি বৃহৎসাম এবং জগতের সকল ছন্দ বা মন্ত্রসমূহের মধ্যে গায়ত্রী ছন্দে গায়ত্রী মন্ত্র শ্রেষ্ঠ।
বৃহৎসাম তথা সাম্নাং গায়ত্রী ছন্দসামহম্।
মাসানাং মার্গশীর্ষোঽহমৃতূনাং কুসুমাকরঃ।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা : ১০.৩৫)
‘আমি গীতযোগ্য শ্রুতির মধ্যে বৃহৎসাম, ছন্দসমূহের মধ্যে গায়ত্রী ছন্দ, মাসসমূহের মধ্যে অগ্রহায়ণ এবং ষড় ঋতুর মধ্যে ঋতুরাজ বসন্ত।’
গায়ত্রী ছন্দের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে ঋগ্বেদ সংহিতার প্রথম সূক্ত শুরু হয়েছে গায়ত্রী ছন্দে। শ্রীমদ্ভবদ্গীতার দশম অধ্যায় তো বটেই, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন স্থানেই গায়ত্রী মন্ত্রের প্রসঙ্গ পাওয়া যায়।
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের দশম স্কন্ধে পাওয়া যায়, যদুকুলের আচার্য গর্গ মুনির নিকট বলরাম এবং শ্রীকৃষ্ণ উপনয়ন সংস্কার প্রাপ্ত হয়ে দ্বিজত্বে উপনীত হন। তাঁরা বিবিধ ব্রত-নিয়মাদি নিষ্ঠার সাথে অধ্যয়ন-প্রারম্ভের নিয়মানুসারে ব্রহ্মচর্য ব্রত গ্রহণ করে গায়ত্রী মন্ত্র গ্রহণ করেন। অবশ্য তাঁরা দুজনেই এক অচিন্ত্য জগদীশ্বরের দুই অবতার রূপ; তাঁরা উভয়ই প্রভব এবং সর্ববিদ্যায় সর্বজ্ঞ।
এরপরেও লোক দৃষ্টান্তের জন্য তাঁরা যদুকুলের গুরু গর্গ মুনির কাছে উপনয়নের মাধ্যমে গায়ত্রী মন্ত্র লাভ করেন; পরবর্তীতে গুরুকুলে বাস করে শিক্ষালাভের আশায় অবন্তীপুর নিবাসী কাশ্যপ গোত্রীয় সান্দীপনি মুনির নিকট গমন করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
ততশ্চ লব্ধসংস্কারৌ দ্বিজত্বং প্রাপ্য সুব্রতৌ।
গর্গাদ্ যদুকুলাচার্যাদ্ গায়ত্রং ব্রতমাস্থিতৌ।।
প্রভবৌ সর্ববিদ্যানাং সর্বজ্ঞৌ জগদীশ্বরৌ।
নান্যসিদ্ধামলজ্ঞানং গূহমাওনৌ নরেহিতৈঃ।।
অথো গুরুকুলে বাসমিচ্ছন্তাবুপজগ্মতুঃ।
কাশ্যং সান্দীপনিং নাম হ্যবন্তীপুরবাসিনম্।।
(শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ : ১০.৪৫.২৯-৩১)
‘এইভাবে যদুকুলাচার্য গর্গের নিকট উপনয়ন সংস্কার প্রাপ্ত হয়ে বলরাম এবং শ্রীকৃষ্ণ দ্বিজত্বে উপনীত হলেন। তাঁরা পূর্ব হতেই ব্রত-নিয়মাদির প্রতি নিষ্ঠাপরায়ণ ছিলেন, এখন গায়ত্রী ধারণ করে অধ্যয়ন-প্রারম্ভের নিয়মানুসারে ব্রহ্মচর্য ব্রত গ্রহণ করলেন।
মহারাজ পরীক্ষিৎ! এটাও ভগবানের এক লীলা! তাঁরা দুজনেই তো এক অচিন্ত্য জগদীশ্বরের দুই অবতার রূপ; তাঁরা উভয়ই প্রভাব এবং সর্ববিদ্যায় সর্বজ্ঞ। তাঁদের বিশুদ্ধ জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধ, অন্য কোনো ব্যক্তি বা পদার্থের ওপরে তা নির্ভরশীল নয়। তা সত্ত্বেও তাঁরা মানুষের মতো আচরণ করে লোকদৃষ্টান্তের জন্য নিজেদের সেই চিরন্তন জ্ঞান অপ্রকাশিত করে রাখলেন। অতঃপর তাঁরা গুরুকুলে বাস করার ইচ্ছায় অবন্তীপুর নিবাসী কাশ্যপ গোত্রীয় সান্দীপনি মুনির নিকট গমন করলেন।’
শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের ৭০তম অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিনচর্যার একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা পাওয়া যায়। যা সকল জীবের যথাসাধ্য অনুসরণ করা কর্তব্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তেই শয্যাত্যাগ করতেন এবং হস্তবদনাদি প্রক্ষালিত করে মৌন হয়ে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতেন।
ব্রাহ্মে মুহূর্ত উত্থায় বায়ুপস্পৃশ্য মাধবঃ।
দধ্যৌ প্রসন্নকরণ আত্মানং তমসঃ পরম্।।
একং স্বয়ংজ্যোতিরনন্যমব্যয়ং
স্বসংস্থয়া নিত্যনিরস্তকল্মষম্।
ব্রহ্মাখ্যমস্যোদ্ভবনাশহেতুভিঃ
স্বশক্তিভিলক্ষিতভাবনিবৃতিম্।।
অথাপ্লুতোঽম্ভস্যমলে যথাবিধি
ক্রিয়াকলাপং পরিধায় বাসসী।
চকার সন্ধ্যোপগমাদি সত্তমো
হতানলো ব্রহ্ম জজাপ বাগ্ যতঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত:১০.৭০.৪-৬)
‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তেই শয্যাত্যাগ করতেন এবং হস্তবদনাদি প্রক্ষালিত করে নিজ মায়াতীত আত্মস্বরূপের ধ্যানে মগ্ন হতেন। তাঁর দেহের রোমকূপে তখন যেন আনন্দের বিচ্ছুরণ হতো।
হে পরীক্ষিৎ! শ্রী ভগবানের সেই আত্মস্বরূপ সজাতীয়-বিজাতীয় এবং স্বগতভেদরহিত এক, অদ্বিতীয় ও অখণ্ড–কেননা তাতে উপাধি অথবা উপাধির কারণরূপ অন্য কোনো বস্তুর অস্তিত্বই নেই। সেই কারণেই তা অবিনাশী সত্য। যেমন চন্দ্র-সূর্য প্রভৃতি নেত্র ইন্দ্রিয়ের দ্বারা এবং নেত্র ইন্দ্রিয় চন্দ্র-সূর্য প্রভৃতির দ্বারা প্রকাশিত হয়, তদনুরূপ আত্মস্বরূপ অপরের দ্বারা প্রকাশিত নয়, স্বয়ং প্রকাশিত।
গায়ত্রী ছন্দের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে ঋগ্বেদ সংহিতার প্রথম সূক্ত শুরু হয়েছে গায়ত্রী ছন্দে। শ্রীমদ্ভবদ্গীতার দশম অধ্যায় তো বটেই, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন স্থানেই গায়ত্রী মন্ত্রের প্রসঙ্গ পাওয়া যায়।
তার কারণ এই যে নিজ স্বরূপে নিত্য অবস্থান এবং কালের সীমার বাইরেও অসংস্পৃষ্ট থাকার কারণে অবিদ্যা তাকে স্পর্শও করতে সক্ষম হয় না। তাতে প্রকাশ্য ও প্রকাশক ভাব আদৌ থাকে না।
জগতে সৃষ্টি, স্থিতি, লয়ের কারণরূপে ব্রহ্মশক্তি, বিষ্ণুশক্তি এবং রুদ্রশক্তি-সব দ্বারা কেবল এই অনুমান করা সম্ভব হয় যে সেই স্বরূপ অসংস্পৃষ্ট এক সত্তাস্বরূপ ও আনন্দস্বরূপ। সাধারণভাবে বোঝাবার জন্য তাকে ‘ব্রহ্ম’ বলা হয়ে থাকে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রতিদিন নিজে সেই আত্মস্বরূপের ধ্যান করে থাকেন। অতঃপর তিনি বিধি অনুসারে নির্মল ও পবিত্র জলে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র ও উত্তরীয় ধারণ করে যথাবিধি নিত্যকর্ম সন্ধ্যা-বন্দনাদি করেন।
অতঃপর তিনি যজ্ঞ করতে বসেন ও মৌন ধারণ করে গায়ত্রী জপ করেন। তিনি এইসব কর্ম করেন কারণ তিনি যে সজ্জনদের আদর্শ ব্যক্তিসম।’
শ্রীমদ্ভাগবতের মতো একই প্রকারের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শয্যা থেকে উত্থিত হওয়ার বর্ণনা মহাভারতের শান্তিপর্বের মধ্যেও পাওয়া যায়।
বৈশম্পায়ন উবাচ।
ততঃ শয়নমাবিশ্য প্রসুপ্তো মধুসূদনঃ।
যামমাত্রাৰ্দ্ধশেষায়াং যামিন্যাং প্ৰত্যবুধ্যত॥
স ধ্যানপথমাবিশ্য সৰ্বজ্ঞানানি মাধবঃ ।
অবলোক্য ততঃ পশ্চাদ্দধ্যৌ ব্ৰহ্ম সনাতনম্।।
(মহাভারত : শান্তিপর্ব, ৫২.১-২)
‘বৈশম্পায়ন বললেন—এরপর কৃষ্ণ শয্যায় প্রবেশ করে নিদ্রিত হলেন এবং রাত্রি যামাৰ্দ্ধমাত্র অবশিষ্ট থাকতেই তাঁর নিদ্রা ভঙ্গ হলো।
তদনন্তর যাতে সমস্ত জ্ঞান উৎপন্ন হয়, সেইভাবে ধ্যান অবলম্বন করে, তিনি নাকের অগ্রদেশ দেখতে দেখতে সনাতন ব্রহ্মের চিন্তায় মগ্ন হলেন।’
এই অধ্যায়ের পরবর্তী সপ্তম শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শয্যা থেকে উঠে স্নান সমাপন করে গোপনীয় গায়ত্রী মহামন্ত্র জপ করে প্রাতঃসন্ধ্যা সমাপনের বর্ণনা পাওয়া যায়।
তত উণ্থায় দাশার্হঃ স্নাতঃ প্রাঞ্জলিরচ্যুতঃ।
জপ্ত্বা গুহ্যং মহাবাহুরগ্নীনাশ্রিত্য তস্থিবান্।।
(মহাভারত : শান্তিপর্ব, ৫২.৭)
‘অনন্তর মহাবাহু শ্রীকৃষ্ণ শয্যা হতে উঠে, স্নান করে, হস্তযুগল প্রাঞ্জলিবদ্ধ করে গুহ্য গায়ত্রী মহামন্ত্র জপ করে প্রাতঃসন্ধ্যা সমাপন করলেন। এরপরে হোমাগ্নির নিকট গিয়ে, প্রাতঃকালীয় হোম নিষ্ঠার সাথে সমাধা করলেন।’
লিখেছেন: কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়