সরকার বদল হলেও পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশে আমার ফেরা সম্ভব হয় না: তসলিমা নাসরিন
কলকাতা ট্রিবিউন ডেস্ক: মানবতাবাদী নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন গত ২১ শে নভেম্বর তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে উল্লেখ করেন যে তিনি ইউরোপ-আমেরিকা ত্যাগ করে প্রাণের টানে, ভাষার টানে কলকাতায় বাস করতে এসেছিলেন। ৭ নম্বর রডন স্ট্রিটের বাড়িতে সাজিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর সংসার। তিনি কলকাতা-বাসের তিন বছর পার হওয়ার পর তাঁকে গৃহবন্দি করেছিল পশ্চিমবঙ্গের সরকার।
নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন উল্লেখ করে বলেন যে, ২০০৭ সালের অগাস্ট মাসের ৯ তারিখে গৃহবন্দিত্ব শুরু হয়েছিল আমার। কী দোষ ছিল আমার? কিছুই না। অথচ গৃহবন্দিত্ব ঘোচানোর কোনও ইচ্ছেই সরকারের ছিল না। আমার কোনও অধিকার ছিল না বাড়ির বাইরে পা ফেলার। বেরোতে গেলে পুলিশ আমাকে বাধা দিত। ওদিকে মূখ্যমন্ত্রী আমাকে শহর ছাড়ার জন্য, রাজ্য ছাড়ার জন্য, এমনকী দেশ ছাড়ার জন্য পুলিশ কমিশনারকে পাঠাতেন আমার কাছে। প্রসূন মুখোপাধ্যায় আমাকে শাসিয়ে যেতেন, রাজ্য না ছাড়লে অবস্থা ভাল হবে না বলে যেতেন। আমাকে ফোনেও শাসাতেন। তারপরও আমি শহর ছাড়িনি, রাজ্য ছাড়িনি। বন্ধুরাও ভয়ে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছিল আমার বাড়িতে। আমি শক্তিহীন ক্ষমতাহীন দেশ-হারা স্বজন-হারা এক অসহায় বাঙালি লেখক একা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলাম বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে। আমি বলেছিলাম, আমি যাবো না কোথাও, গৃহবন্দি করেছ, এভাবেই থাকবো। আমি যাবো না, কারণ আমি কোনও অন্যায় করিনি। নারীর সমানাধিকারের পক্ষে, সমতার পক্ষে, মানবাধিকারের পক্ষে, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে আমার সংগ্রাম, আমার আদর্শের বিরুদ্ধে তোমাদের তো দাঁড়াবার কথা নয়। তবে?
আজ থেকে ঠিক ১৬ বছর আগে, এই দিনে, ২১ নভেম্বর তারিখে, কলকাতার রাস্তায় মুসলিম চোর ছ্যাচড় পকেট্মারদের বের করে একটা রায়ট নাটক সাজিয়ে, আর্মি নামিয়ে বলে দেওয়া হয়, ওরা তসলিমাকে চাইছে না, সুতরাং তসলিমার তো কলকাতায় থাকা উচিত নয়। মনে হচ্ছে ওই অশিক্ষিত অবাঙ্গালি সমাজ-বিরোধীরা সিদ্ধান্ত নেবে কলকাতায় কে থাকবে, কে থাকবে না। চার মাস গৃহবন্দি রেখেও যেহেতু আমাকে বের করা গেল না রাজ্য থেকে, সেকারণেই ড্রামার দরকার পড়েছিল। ওই মুসলমানদের তো যাকে চেনে না, যার বই কোনওদিন পড়েনি, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল না। বরং ক্ষোভ ছিল সরকারের ওপর, যে সরকার সিঙ্গুর নন্দিগ্রামে মুসলমান মেরেছে, রিজওয়ানকে মেরেছে!
সাম্যবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন আরো উল্লেখ করে বলেন যে,২২ নভেম্বরে আমাকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে পুলিশ নিয়ে যায় বিমান বন্দরে। সরকারের কী লাভ হয়েছিল আমাকে তাড়িয়ে? আমি কার কী নষ্ট করেছিলাম? আমি নিজের টাকায় নিজের মতো বাংলাকে ভালোবেসে নিভৃতে বাস করছিলাম বাংলায়। জানি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুশি হয়েছিলেন। উনি এটাই চেয়েছিলেন, সম্ভবত উনিই কলকাঠি নেড়েছিলেন। যে বিমান বসু ২০০৫ সালের বঙ্গ সম্মেলনে মাথা উঁচু করে আমার ”আমেরিকা” কবিতাটি পাঠ করেছিলেন, তিনি অত তাড়াতাড়ি তসলিমা বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন কেন? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যিনি নন্দনে আমাকে ডেকে নিয়ে গল্প করতেন, তাঁর তো তসলিমা-বিরোধী হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। তবে কী ঘটেছিল? দ্বিখণ্ডিত কার পরামর্শে তিনি নিষিদ্ধ করেছিলেন? ২৫ জন বুদ্ধিজীবীর পরামর্শে, তিনি নিজেই বলেছিলেন। ২৫ জন বুদ্ধিজীবীর প্রধান ছিলেন তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
পৃথিবীতে সরকার বদল হলে নির্বাসিত লেখক দেশে ফিরতে পারে। কেবল আমার বেলায় ঘটনা ভিন্ন। সরকার বদল হলেও, না বাংলাদেশে, না পশ্চিমবঙ্গে, আমার ফেরা হয় না। কী অন্যায় করেছিলাম আমি? একটিই উত্তর, কিছুই না, মানবতাবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন আক্ষেপ করে তার ফেসবুক পোস্টে এ মন্তব্য করেন।