Wednesday, May 8, 2024
আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশের অপর্ণা শক্তিপীঠ , মন্দিরের শতশত একর জমি বেদখল

সংগ্রাম দত্ত: বাংলাদেশের বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামে অবস্থিত এই মন্দিরটি হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি শক্তিপীঠ যা ভবানীপুর শক্তিপীঠ বা অপর্ণা শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিত। এ শক্তিপীঠ বামতল্প নামেও পরিচিত।

বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার ও শেরপুর উপজেলা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন করতোয়া ( বর্তমানে বিলুপ্ত) নদীর তীরে অবস্থিত ভবানীপুর গ্রামে উপমহাদেশের সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে ভবানী শক্তিপীঠ বা তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞের পর সতী মাতা দেহ ত্যাগ করলে মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করলে বিষ্ণু দেব সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতী মাতার দেহখন্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয় এবং এ সকল স্থানসমূহ শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিতি পায়। বিভিন্ন সূত্র মতে, করতোয়া তটের ভবানীপুরে সতী মাতা তারার বাম পায়ের অলঙ্কার বা বাম পাঁজর বা ডান চোখ বা বিছানা পড়েছিল বলে জানা যায়।

ভবানীপুর বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত শক্তিপীঠসমূহের মধ্যে অন্যতম। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশ-বিদেশের ভক্তরা সারা বছর এখানে তীর্থে আসেন।

কথিত আছে যে এখানে একদা একজন শাঁখাওয়ালা (শাঁখা নির্মাতা) ভবানীপুর মন্দিরের ধারের গভীর জঙ্গলের পাশের একটি পুকুরের ধার অতিক্রম করছিলেন। এমন সময় সিঁথিতে সিঁদুর দেয়া একটি ছোট মেয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বলেছিলেন যে তিনি মন্দিরের পুরোহিতের কন্যা। তিনি শাঁখাওয়ালার কাছ থেকে এক জোড়া শাঁখা কিনে বললেন যে শাঁখাওয়ালা যেন মন্দিরের পুরোহিতকে বলতেন মন্দিরের কুঠুরীতে (ঝুড়ি )রাখা পয়সা থেকে তাঁর শাঁখার দাম দিতে। শাঁখাওয়ালা মেয়েটির বিনীত কথায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে শাঁখা প্রদান করেন এবং তিনি মন্দিরের পুরোহিতের কাছে গিয়ে এর দাম পরিশোধ করতে বললে তিনি বলেন তাঁর কোন কন্যা নেই এবং পুরোহিত ও শাখাওয়ালা দুজন মিলে পুকুরের কাছে মেয়েটিকে দেখার উদ্দেশ্যে যান । শাঁখাওয়ালার প্রার্থনা শুনে মা ভবানী তারা সেই পুকুরে তাঁর দুই হাতের শাঁখা পরিহিত অবস্থায় লাল দু’হাত উত্তোলিত করে দেখালেন। মন্দিরের পুরোহিত ও শাখাওলাসহ সেখানে উপস্থিত লোকজন তা অবলোকন করে বিস্মিত হলেন । সেই থেকেই এই পুকুরের নাম শাঁখা পুকুর হিসেবে এর নাম উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে । সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে এ পুকুরের স্নান করলে তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হবে। 

 হিন্দু ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার নারী-পুরুষ মন্দির প্রাঙ্গণে সমবেত হন এবং শাঁখারী পুকুরে পুণ্যস্নান শেষে পূজা অর্চনা করেন। 

এই শক্তিপীঠের শক্তি দেবী অপর্ণা এবং ভৈরব বামেশ বা বামন নামে পরিচিত। তন্ত্রচুড়ামণিতে আছে —

করতোয়াতটে কর্ণে বামে বামনভৈরবঃ।

অপর্ণা দেবতা যত্র ব্রহ্মরূপাকরুদ্রবঃ।।

চার একর (১২ বিঘা) জমির ওপর প্রাচীর বেষ্টিত মন্দির চত্বর। মূলমন্দির, বেলবরণ তলা, শিব মন্দির ৪টি, পাতাল ভৈরব শিব মন্দির, গোপাল মন্দির, বাসুদেব মন্দির ও নাট মন্দির/আটচালা। উত্তরাংশে সেবা অঙ্গন, পবিত্র শাঁখা পুকুর, স্নানঘাট তিনটি, বেষ্টনী প্রাচীরের বাইরে চারটি শিব মন্দির ও একটি পঞ্চমুন্ড আসন রয়েছে।

প্রাচীন মন্দিরটি বয়সের ভারে জরাগ্রস্ত। অতিথিশালার ছাদ ধসে পড়েছে। হরেক জাতের লতাগুল্ম নিরুপদ্রবে বেড়ে উঠেছে দেয়ালে-অন্দরে। সীমানাপ্রাচীরের শীর্ষদেশ ঢেউ খেলানো। তাতে যে কারুকাজ ছিল, তা ঢেকে গেছে বহুদিনের জমে ওঠা ধুলো আর শেওলায়। 

ভেতরে ১ একর ৬২ শতাংশ জায়গাজুড়ে ফলদ-বনজ গাছের ছায়া-সুনিবিড় পরিবেশে স্থাপিত ছোট-বড় আটটি মন্দির। সীমানাপ্রাচীরের উত্তরে ঘাটবাঁধা বিশাল পুকুর। অতি মনোরম দৃশ্যপট। মন্দিরের পাশের পুকুরটি প্রায় তিন একরের।

 সতীদেহের বাঁ পাঁজরের অস্থি পড়েছিল ভবানীপুরে। বাঁ পাশের পাঁজরের হাড় এখানে পড়ায় এই পীঠস্থানটির নাম ‘বামতল্প’।

ভবানীপুর হিন্দুদের একটি পীঠস্থান। এখানে নাটোরের মহারাজা কর্তৃক নির্মিত মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে। কিন্তু এই স্থান আরও প্রাচীন। বহু প্রাচীন দুর্গ ও ইমারতাদির ধ্বংসাবশেষ এবং জলাশয় এখানে দেখা যায়।

মন্দিরের আশপাশে এখন ঘনবসতি। তা সত্ত্বেও ইমারতের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন, ইটের টুকরা ও পুকুরগুলো পুরোনো দিনের স্মৃতির নিদর্শন হয়ে আছে।

বছরে দুবার এখানে পুণ্যার্থীদের আগমন ঘটে। মাঘ মাসের পূর্ণিমায় এক দিনের পূজা। চৈত্র মাসের অষ্টমী, নবমী ও দশমীতে হয় তিন দিনের পূজা। তখন জমজমাট মেলা বসে মন্দিরের আশপাশে। পুকুরে পুণ্যস্নান করেন ভক্তরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এবং ভারত থেকেও প্রচুর পুণ্যার্থী আসেন বাসন্তী পূজায়। এ ছাড়া সারা বছরই মানত ও ব্যক্তিগতভাবে পূজা দিতে ভক্তদের আগমন ঘটে। পুণ্যার্থীদের দেওয়া অর্থে সংস্কারের কাজ চলছে। প্রধান মন্দিরটির নাম ‘মা ভবানী মন্দির’। এটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। সামনের প্রাঙ্গণে সিরামিক টালি বসানো হচ্ছে। নির্মাণ করা হচ্ছে অতিথিশালা। তবে কাজ চলছে ধীরে।

অন্যান্য মন্দিরের মধ্যে তারকেশ্বর মন্দিরটির চৌচালা ছাদের ওপর গম্বুজ আকৃতির চূড়া। বাংলাঘরের ছাদের মতো ছাদের কিনার ধনুকের মতো বাঁকানো। চমৎকার গড়ন। দক্ষিণেশ্বর শিবমন্দির, পিঙ্গেশ্বর শিবমন্দির দুটি আকারে ছোট। অষ্টকোনাকৃতির। বামেশ ভৈরর মন্দিরটি একতলা সাধারণ ঘরের আকারের। এ ছাড়া আছে গোপাল মন্দির ও বাসুদেব মন্দির। এসব মন্দিরের দেয়াল ও চূড়ায় শিবমূর্তি ও ধর্মীয় প্রতীকের কারুকাজখাচিত।

১৭৪৫ সালে নাটোরের মহারাজা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মহারাজার নিয়োগ মোতাবেক বংশপরম্পরায় নায়েব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়মিত দেবসেবা করে যাচ্ছেন। নাটোরের রানী মাতা ভবানী বছরে দু’বার হাতি নিয়ে এখানে পরিদর্শনে আসতেন বলে জানা যায়।

মন্দির পরিচালনা কমিটির নির্বাহী সদস্য দিলীপ কুমার দেব ও মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক অপূর্ব চক্রবর্তী জানান নাটোরের ভবানীপুর স্টেট এর রাজা মন্দিরের নামে 

নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় ২৬২ একর ভূমি ঘোষণা করে দান করেন।  

জানা গেছে, মন্দিরের শত শত একর ভূমি একশ্রেণীর প্রভাবশালী মহল কর্তৃক বেদখল রয়েছে। বর্তমানে মন্দিরের দখলে প্রায় ১০০ বিঘা ভূমি রয়েছে বলে মন্দির কমিটির উপরোক্ত দুই সদস্য জানিয়েছেন।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাক সরকার প্রজাস্বত্ব আইন সৃষ্টি করলে নাটোর ভবানীপুর স্টেট এর ছোট তরফের মহারাজা বীরেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর ১৮৬.৫২ একর ভূমি চয়েজ ল্যান্ড হিসেবে মন্দিরের নামে দান করেন। যা দেবত্বোর হিসেবে ১৯৫৪ সনে ৬০ নম্বর মিসকেস এ রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার রেজিস্ট্রির মাধ্যমে এক খতিয়ানে দেবত্তোর সম্পত্তি হিসেবে দলিল করে দেন। এর পূর্বের প্রায় ৭৬ একর ভূমি এই দলিলের বাইরে দেবত্তোর সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত ছিল বলে মন্দির পরিচালনা কমিটির নির্বাহী সদস্য দিলীপ কুমার দেব জানিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, এ শক্তিপীঠে বহুকাল পূর্ব থেকেই এখানে পূজা-অর্চনা চলছিল। 

‘৬০ এর দশকে পাকিস্তান সরকার সম্পূর্ণ সম্পত্তির মূল মন্দিরসহ ডিসির ১ নং খতিয়ানে খাস হিসেবে রেকর্ড ভুক্ত করে।

‘৯০ এর দশকে শক্তিপীঠ পরিচালনা কমিটি বগুড়া জজ কোর্টে মামলা করে জয়লাভ করে। সরকারপক্ষ আপিল করে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে রিভিউর নিয়ে যায়। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রিভিউতে ১৭.৩১ একর ভূমি মন্দির এর পক্ষে দেবত্বোর সম্পত্তি হিসেবে রায় প্রদান করেন। 

বর্তমানে ৭০.৬২ একর ভূমি নিয়ে বগুড়া জজ কোর্টে দুটি মামলা চলমান আছে।

অন্যদিকে ৭৪ একর ভূমি নিয়ে সিরাজগঞ্জ জজ কোর্টে অপর একটি মামলা চলমান আছে।

৯০ দশকের পর শক্তিপীঠ পরিচালনা কমিটির কর্তৃক এ সতীপীঠে অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।

শক্তিপীঠ পরিচালনা কমিটি কর্তৃক বিগত তিন বছরে সীমানা প্রাচীন নির্মাণ আটটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রায় কোটি টাকার উপরে উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে।

৬১৫ মিটার সীমানা প্রাচীর, ২০ লাখ টাকা ব্যায়ে সিংহদ্বার বা মূল গেইট ও প্রায় এক হাজার লোক এক সঙ্গে বসে সেবা করার জন্য একটি সেবাঙ্গন নির্মাণ করা হয়েছে। 

কমিটির সদস্য দিলীপ কুমার দেব আরো জানিয়েছেন যে কমিটি কর্তৃক মন্দির সংস্কারের জন্য আরো বৃহৎ পরিকল্পনা আছে। এ জন্য পাঁচ কোটি টাকার ব্যয় হবে। অপর্ণা মায়ের মূল মন্দিরের কাজ, আরো একটি স্নানাগার ঘাট নির্মাণসহ মন্দিরের অন্যান্য উন্নয়ন কাজ পরিচালিত হবে বলে নির্বাহী সদস্য দিলীপ কুমার দেব জানিয়েছেন।

২০১৭ সালের দিকে একটি ভিআইপি অফিস রুম তৈরি করা হয়। এ রুমটিতে প্রায় ১০০ লোক একসাথে বসতে পারে। এ অফিস রুমের জন্য ২০২২ সালে ভারতের স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া কয়েক লক্ষ টাকার ফার্নিচার প্রদান করে।

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে যৌথ বাহিনী কর্তৃক মন্দিরের অতিথি শালা, নায়েবের বাড়ি ও মন্দিরের গেট আক্রান্ত হয় বলে খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে মন্দির কমিটি বিভিন্ন জায়গায় লেখালেখি করে প্রতিকারও চেয়েছেন। পরবর্তীতে জেলা পরিষদ সরকারি অনুদান দিয়ে একটি রেস্ট হাউস তৈরি করে দেয়।

দেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ০৬ আগস্ট ২০১৪ ভবানীপুর পুরাকৃতির মন্দিরের জমি বেদখল হয়ে গেছে একটি প্রতিবেদন ও প্রকাশ করেছে। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও চলছে। উদ্ধার হওয়া কঠিন। 

ভক্তদের প্রত্যাশা, প্রাচীন এই স্থাপনা ও ধর্মীয় পুণ্যময় পীঠস্থানটির সংস্কারে সরকার সহায়তা দেবে।