Saturday, October 12, 2024
সম্পাদকীয়

পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সারদা পীঠ মন্দির কি পুরোপুরি ধ্বংসের পথে?

সংগ্রাম দত্ত:

—————-

সম্প্রতি টার্গেট করে পাকিস্তান সেনা গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে থাকা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ১৮ মহাশক্তিপীঠের এক পীঠ সারদা পীঠ মন্দিরকে।

ভারতীয় মিডিয়ার রিপোর্ট বলছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে নীলম নদীর তীরে পাহাড়ি গ্রাম সারদা। এখানেই আছে সুপ্রাচীন তীর্থক্ষেত্র সারদা পীঠ। সেই সারদাপীঠের জমি দখল করতে উঠেপড়ে লেগেছে পাক আর্মি । কিন্তু পাকিস্তানের সেনাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা পিওকের স্থানীয়রাই সেনাদেরকে খেদিয়ে বের করে দিচ্ছে এলাকা থেকে।  

মুসলিমরা বুক দিয়ে আগলাচ্ছে হিন্দু মন্দিরকে। একসময় এই মন্দিরে মা দুর্গার এক রূপ সারদা দেবীর মূর্তি ছিল। কাশ্মীরী পণ্ডিতরা এখন আর এই পীঠ দর্শন করতে পারেন না। তাই সারদা পীঠ সংলগ্ন গ্রামের মুসলিম অধিবাসীরা ২০১৮ সালে এই মন্দির চত্বরের মাটি সংগ্রহ করে পাঠিয়ে ছিলেন কাশ্মীরী পণ্ডিতদের কাছে। 

হিন্দু বিশ্বাস মতে ১৮টি মহাশক্তিপীঠের অন্যতম এই মন্দির। হিন্দু ধর্ম মতে এখানে সতীর ডান হাত পড়েছিল। 

পাক অধিকৃত কাশ্মীর যবে থেকে পাকিস্তানের অংশ হয়েছে, তারপর থেকে ধ্বংসাবশেষ ছাড়া এই মন্দিরের এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। যদিও এর আগেও মন্দিরের বাইরের দেওয়াল ভেঙে সেখানে কফি শপ বানিয়ে ছিল পাকিস্তান সেনা। এবার জোর করে জমি দখলের চেষ্টা। প্রাচীন ইতিহাসে অনেক সময়ই কাশ্মীরের উল্লেখ আছে শারদা-দেশ নামে শারদা পীঠের কারণেই এই নাম বলে মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। 

১৯৪৭ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় পাশতুন উপজাতিদের দখলে আসে এই এলাকা। ফের বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় শারদা পীঠ। এখন এই মন্দির সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত কোনও বিগ্রহ নেই । 

মাতা সারদা হলেন জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প কলা প্রজ্ঞার দেবী সরস্বতী। কাশ্মীরের হিন্দুরা তাঁর উপাসক তাই তাদের বলা হয় পন্ডিত। এই সারদা শক্তিপীঠ অষ্টাদশ মহাশক্তিপীঠের অন্তর্গত। সারদা শক্তিপীঠ বর্তমান পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ১৫০ কিমি ও শ্রীনগরের থেকে ১৩০ কিমি দূরে নিলম নদীর তীরে অবস্থিত। LOC থেকে এর দূরত্ব মাত্র ১০ কিমি। স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুহাজার মিটার উচ্চতায় হরমুখ পর্বত ও নিলম নদীর উপত্যকায় অবস্থিত। সারদা পীঠ ছাড়াও কাশ্মীরি পন্ডিতদের আরো দুটি বিখ্যাত তীর্থস্থান হল মার্তন্ড সূর্য মন্দির ও অমরনাথ । এর মধ্যে অমরনাথ ছাড়া বাকি দুটি পীঠ ই বিনষ্ট। মার্তন্ড সূর্য মন্দিরের অবস্থান অনন্তনাগ থেকে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত। অষ্টম শতাব্দীতে মার্তন্ড সূর্যমন্দির নির্মাণ করেন কারকোটা রাজা ললিতাদিত্য।

খৃস্টীয় ১৫ শতাব্দীতে সিকান্দার বুৎসিকান এই মন্দির আক্রমন করেন ও সম্পূর্ণ ধ্বংস করেন। 

সারদা দেবী মন্দিরের উচ্চতা ১৪২ ফিট ও চওড়া ৯৫ ফিট দেওয়াল গুলি ৮ ফিট উচ্চতা , ৬ফিট চওড়া ও ১১ফিট লম্বা , এই মন্দির প্রাচীন কাশ্মীরি স্থাপত্যরীতি ও শৈলি অনুরসন করে তৈরি । মার্তন্ড সূর্য মন্দিরের সঙ্গে এই মন্দিরের গঠন শৈলীর অনেক সাদৃশ্য আছে।

অনেকের মতে এই স্থান ৫০০০ বছরের পুরনো । কেউ বলেন দেড় হাজার বছর পূর্বের ইন্দো-আরিয়ান দের সময়ে এই মন্দির আবার অনেকে এই অঞ্চলের অতি প্রাচীন বাসিন্দা ইন্দো আফগানদের সময়ে এই মন্দির। তবে সবচেয়ে জোরালো মতটি হল কুশান শাসনকালে ৩০ থেকে ২৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই মন্দির নির্মিত হয়।কলহনের রাজতরঙ্গিনী মতে বর্তমান মন্দির অষ্টম শতাব্দীতে ললিতদিত্যের সময়ে নির্মিত হয়। ইসলামিক আগ্রাসনের পূর্বে সারদাপীঠ ছিল হিন্দু -বৌদ্ধ , বৈদিক সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র । সেই সময় কাশ্মীরে বৌদ্ধ জনবসতি ও ছিল। কুশান সম্রাট কনিষকের উদ্যোগে চতুর্থ বৌদ্ধ সংহতি হয়েছিল কাশ্মীরে I আদি শংকরাচার্য্য এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে । কেবল ভারত নয় নেপাল, তিব্বত ,ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, আফগানিস্তান, ভুটান, ইরান , থাইল্যান্ড থেকেও বহু জ্ঞানপিপাসু শিক্ষার্থীদের যাতায়াত ছিল। আদি শংকরাচার্য্য, কুমারজীব, বৈরতসন এর মত বহু স্কলারের পদধূলি ধন্য এই পীঠ। সারদা স্তবে তাঁকে বলা হচ্ছে কাশ্মীরপুরবাসিনি অর্থাৎ One who Resides in kashmir , তাই কাশ্মীরের আরেক নাম সারদাদেশ । সারদা পীঠের কথা সর্বপ্রথম পাওয়া যায় নীলামাতা পুরানে। কাশ্মীরি তন্ত্র মতে ও কাশ্মীরি পন্ডিতদের বিশ্বাস অনুসারে ঋষি শান্ডিল্য মাতা সরস্বতীর তপস্যা করেন । দেবী তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে আশ্বাস দেন তিনি তাঁর স্বরূপ দর্শন করাবেন এবং তাঁকে কিসেনগঙ্গার তীরে যেতে আদেশ করেন। ঋষি সারদা বনের মধ্য দিয়ে কিসেনগঙ্গায় এসে পৌঁছান পথে পূর্বদিকে তাঁর সঙ্গে শ্রী গণেশের সাক্ষাৎ হয়। সেই স্থান আজো গনেশ ঘাটি নামে পরিচিত। কিসেনগঙ্গায় স্নান করে উঠে ঋষি দেখেন তাঁর অর্ধেক শরীর স্বর্ণমন্ডিত হয়েছে। সেই সময় দেবী তাঁকে তাঁর সারদা, সরস্বতী ও বাগদেবী এই তিন স্বরূপে দর্শন দেন ও ক্রোড়ে আহ্বান করেন। ঋষির কমন্ডলুস্থিত জলের অর্ধেক মধুতে রূপান্তরিত হয় ও একটি ধারা নির্গত হয় যা মধুমতি নদী নামে পরিচিতি লাভ করে। এই মধুমতি নদীই বর্তমানে নিলম নদী। 

কাশ্মীরি পন্ডিতগন বিশ্বাস করেন যে এই কিসেনগঙ্গা ও মধুমতি নদীর সঙ্গম স্থলে স্নান করলে পাপ মোচন হয় । ব্রিঙহিসা সংহিতার সারদা মাহাত্ম অংশ থেকে জানা যায় ভাদ্রের শুক্ল অষ্টমী তিথিতে এখানে বিশেষ তীর্থযাত্রা হত। গোপীনাথ কবিরাজ মহাশয় তাঁর লেখায় বলেছেন ঋষি কশ্যপের কথা এই কাশ্মীর প্রসঙ্গে। এবং উনি কাশ্মীর নামের অর্থ করেছেন, কাশ্যপ মীড় বা ঋষি কাশ‍্যপের নিবাস। আবার কাশ্যপ শব্দের অর্থ করেছেন, কাশ্যপ – কাশ্যপ – পশ্যক অর্থাৎ প্রকাশক। দেখাযায় কাশ্মীরবাসীদের প্রধান তিন উপাস‍্যের মধ্যে একটি হলো সূর্য। 

বাঙালির কাছে যেমন কালীঘাট, অসমীয়াদের কাছে যেমন কামাখ্যা, উড়িয়াদের কাছে যেমন পুরীর জগন্নাথ মন্দির, দক্ষিণ ভারতীয়দের কাছে যেমন তিরূপতি বালাজি, গুজরাটিদের কাছে যেমন দ্বারকাধীশ তেমনই কাশ্মীরি পন্ডিতদের কাছে আবেগের তীর্থস্থান হল সারদা মন্দির। 

চীনা পরিব্রাজক হিউয়েনসাং ৬৩২ খৃস্টাব্দে সারদা পীঠে আসেন এবং এখানে দু বছর যাবৎ অবস্থান করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে এই স্থানের সৌন্দর্য মাহাত্ম্য ও মুগ্ধতা, জ্ঞানচর্চার কথা লেখেন। 

১১৪৮ খৃস্টাব্দে কলহন তাঁর লেখা রাজতরঙ্গিনি তে লেখেন অষ্টম শতাব্দীতে কাশ্মীরে রাজা ললিতদিত্যের সময় গৌড় বা বঙ্গদেশ থেকে এক রাজার সারদাপীঠে আসার কথা । 

প্রখ্যাত ব্যাকরণবিদ পানিনির লেখা বিশ্বের প্রথম ব্যাকরণ গ্রন্থ “অষ্টধ্যয়ী” একসময় এখানে সংরক্ষিত ছিল। 

প্রভাবক চরিত অনুসারে ১২৭৭ এর দিকে জৈন স্বেতাম্বর স্কলার আচার্য হেমচন্দ্র রাজা জয়সিংহ সিদ্ধরাজকে অনুরোধ করেন সারদা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দল পাঠাতে। এরপর তিনি সারদা পীঠে যান ও আটটি ব্যাকরণের গ্রন্থ নকল করে আনেন যা পরে “সিদ্ধহেমশব্দানুশাসন” নামে প্রকাশিত হয়। 

১০৩০ খৃস্টাব্দে বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক আল বেরুনী কাশ্মীর আসেন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায় তখন সারদা মন্দিরে একটি কাঠের নির্মিত মূর্তি ছিল। তিনি এই মন্দিরকে মুলতানের সূর্য মন্দির, থানেস্বরের বিষ্ণু চক্রস্বামী মন্দির ও সোমনাথ মন্দিরের সঙ্গে তুলনা করেন।  

আবুল ফজলের কথা অনুযায়ী, এই মন্দির চত্বর পুরোটাই ছিল সোনার মোড়া। প্রতি মাসে পূর্ণিমার আট দিন পর এই মন্দিরে অলৌলিক ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন তিনি। 

 ১৪ শতকে প্রথম এই মন্দিরে বৈদেশিক মুসলিম আক্রমন হয় এবং মন্দির প্রায় সম্পূর্ণ রূপে তছনছ করে দেয় তারা। এরপর একাধিক আক্রমন হতে থাকে ও ধীরে ধীরে নিলম উপত্যকা ও সারদা পীঠের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে কাশ্মীরি পন্ডিত দের। 

১৯০৭ সালে কাশ্মীরের ডোগরা রাজা গুলাব সিং এই মন্দির পুনরুদ্ধার করে মেরামত করেন । ডোগরা শাসনকালে এই স্থান আবার তীর্থযাত্রীদের ভিড়ে ভরে ওঠে। 

১৯৪৭ সালে সন্ত স্বামী নন্দলালজী আগাম বিপদের সম্ভাবনা করে বেশ কিছু পাথরের মূর্তি ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে টিক্কার কুপওয়ারা ও দেবীবাল বারামুলায় নিয়ে আসেন।

২০০৫ সালে কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে এই মন্দির প্রভুত ক্ষতিগ্রস্ত হয় , এর ছাদ ধসে পড়ে ও কেবল কঙ্কাল অবশিষ্ট মাত্র নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে।

২০০৭ সালে কাশ্মীরি পন্ডিতরা আজাদ কাশ্মীর সরকারের কাছে এই স্থান দর্শনের আর্জি জানালে তা তারা নাকচ করে দেয়।

সারদা মন্দির ছাড়াও সমগ্র কাশ্মীর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন মন্দির। মন্দির গুলির বেশির ভাগই পাথরের নির্মিত ও কাশ্মীরি স্থাপত্য শৈলী অনুসরণে তৈরি। মন্দির গুলির চারদিক জল দ্বারা বেষ্টিত ও মাঝে উপাসনা গৃহ। বর্তমানে প্রায় সব মন্দিরই পরিত্যক্ত। 

বর্তমানে পাকিস্তানের একজন মহিলা গবেষক এম এস রুকসানা খান সারদা মন্দিরের ওপর পুরাতাত্ত্বিক গবেষণা করছেন ও অনেক তথ্য , শিলালিপি উদ্ধার করেন। 

বাংলাকে কেন্দ্র করে পূর্ব ভারতে গড়ে ওঠা শক্তিনির্ভর তান্ত্রিক সাধনা ক্ষেত্র ঠিক একই ভাবে সারদা পীঠকে কেন্দ্র করে শৈব তন্ত্রর ক্ষেত্র। যা আজকের কাশ্মীর শৈব তন্ত্র নামে পরিচিত। 

সারদা পীঠ এক রহস্য থেকে যাবে নবীন গবেষক ও সাধকদের কাছে। ভারতের মহা যোনিপীঠ বলে যাকে বলা হয়েছে তার তিন বিন্দু হলো উত্তরে এই সারদা পীঠ দক্ষিণে কন্যাকুমারীর কাছে গুহ্য কালী এবং পূর্বে কামাক্ষ্যা।