Friday, April 19, 2024
সম্পাদকীয়

অর্থ সম্পদ রোজগার নয়, মানবসেবাই সবথেকে বড় প্রাপ্তি রতন টাটার জীবনে

ভারতের প্রথম সারির শিল্পগোষ্ঠী গুলির দিকে চোখ রাখলে প্রথমেই আসে রিলায়েন্স গ্রুপ, দ্বিতীয় বৃহত্তম টাটা গোষ্ঠী এবং তারপরেই আদানি গ্রুপ। ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প গোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও টাটার কর্ণধার রতন টাটা ‘শীর্ষ ধনী’ নন, কেন?

১৮৮৬ সালে জামসেদজি টাটার হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পায় টাটা গ্রুপ। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে পরিচিতি পায় প্রতিষ্ঠানটি। আজ টাটা চালাচ্ছে ৯৬টি কম্পানি। সেখানে ৩০টি প্রতিষ্ঠান পাবলিকলি লিস্টেড হিসেবে অবস্থান করছে। এ তালিকায় আছে টাটা স্টিল, টাটা মটরস, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস। টাটা পাওয়ারসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান। এগুলো সব মিলিয়ে ১৩০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা পরিচালনা করছে। ভারতে রেসপন্সেবল বিজনেস গ্রুপের প্রতি ৫টির মধ্যে ৪টিই টাটার অধীনে। তবুও টাটার কর্ণধার রতন টাটার নাম শীর্ষ ধনীর তালিকায় নেই।

এর কারণ হলো, টাটা পরিবার এবং কম্পানিগুলোর ৬৫ শতাংশই চ্যারিটিতে দিয়ে দেওয়া হয়। তার বিভিন্ন কম্পানির লভ্যাংশ চ্যারিটিতে যোগ হয়, তার ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নয়। টাটার ব্যক্তিগত সম্পদের মূল্য কখনও ১ বিলিয়ন ডলারের সীমারেখা ছাড়ায় না।

টাটা গ্রুপের মানবকল্যাণে অনুদান কেবল ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়, তার আন্তর্জাতিক সংস্থাতেও যায়। টাটা গ্রুপ হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে ৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে।

সম্প্রতি টাটা ঘোষণা করেছে যে, তারা ভারত থেকে পুরোপুরি মেলেরিয়া হটাতে বেঙ্গালুরুতে গড়ে তুলবে টাটা ইনস্টিউট অব জেনেটিক্স অ্যান্ড সোসাইটি। এতে ব্যয় করা হবে 70 মিলিয়ন ডলার।

মানবকল্যাণে টাটার এমন দানবীয় পরিমাণে বিনিয়োগের উদাহরণ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে পারেনি। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সেরা ধনীতে তার নাম আশা করতে পারেন না। রতন টাটার নাম সেই তালিকাতে তাই ওঠে না।

শিল্পপতি রতনজি টাটাকে একবার টেলিফোন সাক্ষাৎকারে একজন রেডিও উপস্থাপক জিজ্ঞাসা করেছিলেন: ‘স্যার, আপনি যখন জীবনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন তখন আপনার কী মনে হয়েছিল?

রতনজি টাটা মুুচকি হেসে বলেছিলেন: ‘আমি জীবনে সুখের চারটি ধাপ অতিক্রম করেছি এবং অবশেষে অন্তিম ধাপে সত্যিকারের সুখের অর্থ আমি বুঝতে পেরেছি।’

প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থ ও মূল্যবান জিনিসপত্র সংগ্রহ এবং সঞ্চয় করলাম বটে তবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই জিনিসগুলির প্রভাব সাময়িক এবং মূল্যবান জিনিসগুলির দীপ্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

এরপর আসে আমার বড় প্রকল্প পাওয়ার তৃতীয় পর্ব। আমি ভারত এবং আফ্রিকায় ডিজেল সরবরাহের 95% মালিক। আমি ভারত ও এশিয়ার বৃহত্তম ইস্পাত কারখানার মালিকও ছিলাম। কিন্তু এখানেও যে সুখ পাব বলে কল্পনা করেছিলাম তা পাইনি। এরপর চতুর্থ পর্যায়টি ছিল যখন আমার একজন বন্ধু আমাকে প্রায় 200 প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য হুইল চেয়ার কিনতে বলেন এবং জোর দিয়েছিলেন যে আমি যেন তার সাথে যাই এবং শিশুদেরকে নিজের হাতে হুইল চেয়ার উপহার দিই। সেখানে আমি নিজ হাতে সব শিশুকে হুইল চেয়ার দিলাম। এই শিশুদের মুখে এক অদ্ভুত আনন্দের আভা দেখলাম। আমি দেখলাম তারা সবাই হুইল চেয়ারে বসে হাঁটছে এবং মজা করছে যেন তারা পিকনিক স্পটে পৌঁছেছে। আমি সেদিন আমার ভিতরে সত্যিকারের সুখ অনুভব করেছি। আমি যখন সেখান থেকে ফিরে যেতে যাচ্ছিলাম, তখন সেই বাচ্চাদেরই একজন আমার পা চেপে ধরল এবং সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার পা শক্ত করে ধরে রাখল।

আমি ঝুঁকে পড়লাম এবং শিশুটিকে জিজ্ঞাসা করলাম: তোমার কি আর কিছু দরকার?

তারপর শিশুটি তার সেই মায়া ভরা চোখে ক্ষণিক তাকিয়ে আমাকে যে উত্তর দিয়েছিল, তা শুধু আমাকে হতবাক করেনি বরং জীবনের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বদলে দিয়েছেল। শিশুটি সেদিন আমায় বলেছিল-

‘আমি তোমার মুখ মনে রাখতে চাই যাতে তোমার সাথে স্বর্গে দেখা হলে আমি তোমাকে চিনতে পারি এবং তোমাকে ধন্যবাদ দিতে পারি।’

অর্থ-পতিপত্তি দিয়ে বিশ্বজয় সহজ হলেও মানুষের হৃদয় হরণ সহজ নয়। তার জন্য মানবকল্যাণের দিকে নজর রাখতে হয়। আমাদের সকলের অন্তরের দিকে তাঁকাতে হবে এবং ভাবতে হবে, এই জীবন-জগৎ এবং পার্থিব যাবতীয় কাজকর্ম ত্যাগ করে কেন তোমাকে মনে করা হবে? কেউ কি আবারও তোমাকে স্মরণ করবে?