Thursday, December 5, 2024
সম্পাদকীয়

দুর্গাপুজো এবং ভোটের আগে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটতে পারে, শঙ্কায় সংখ্যালঘুরা

নিজস্ব প্রতিবেদন: 

 ———————————

সংগ্রাম দত্ত:

দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্গাপূজার আগে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতা ভুগছে।

গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের হিংগানগর কামান্না সরকারপাড়া মন্দিরে কতিপয় দুষ্কৃতকারী গণেশ, সরস্বতী, অসুরসহ কয়েকটি প্রতিমা ভাংচুর করে। স্থানীয় পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের তাম্বুলখানা বাজারের একটি মন্দিরে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা হামলা করে দেবী দুর্গা, গণেশের মূর্তি ভাংচুর করে। ওই দিন গভীর রাতে ওই এলাকায় মূর্তি তৈরির সময় দুর্বৃত্তদের একটি অংশ দেবী দুর্গা, গনেশ সহ আরো অন্যান্য কিছু মূর্তি ভাঙচুর করে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঘটনার তদন্ত করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের আশ্বাস দিয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং অবিলম্বে এ ঘটনায় জড়িত আসামিদের গ্রেফতারের দাবি জানান। দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি।

হবিগঞ্জ জেলার মাধপুর উপজেলার ছাতিয়াইন ইউনিয়নের রামেশ্বর গ্রামের একটি মন্দিরে গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে হামলা চালায় একদল দুর্বৃত্ত। এ সময় দুর্বৃত্তরা মন্দিরের চেয়ার ভাংচুর ও কয়েকজন ভক্তকে মারধর করে। এ ঘটনায় এলাকার ধর্মীয় হিন্দুদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভের সৃষ্টি হলে এবং বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। খবর পেয়ে স্থানীয় পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল শহরের আরামবাগ আবাসিক এলাকার একটি হরিজন পল্লীতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শ্রীমঙ্গলের হরিজন ( দলিত)সম্প্রদায়ের হিন্দুরা কিছু দুষ্কৃতকারী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। দুর্বৃত্তরা দরিদ্র হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাংচুর করে এবং তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে।

জানা গেছে, কয়েকদিন আগে জয় রবিদাসের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে শফিক মিয়া নামে এক যুবক।

জানা যায়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে একদল যুবক ঘাতক অস্ত্রে সজ্জিত হিন্দুদের হরিজন পল্লীতে হামলা চালায়, ঘরে ঢুকে মেয়ে ও নারীসহ লোকজনকে মারধর করে এবং মন্দির ভাঙচুর করে। হামলাকারীরা বাড়ি থেকে মূল্যবান জিনিসপত্রও লুট করে। স্থানীয় পুলিশ রফিককে আটক করলেও বাকিরা পলাতক থাকে।

 গত ২ মে ভোররাতে কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার নওডাঙ্গা ইউনিয়নের গুড়াকমণ্ডল রায়পাড়া গ্রামে চারটি মন্দিরে হামলা ও ভাংচুর করা হয়। এ সময় অন্তত ৮টি প্রতিমা ভাংচুর করে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা।

রায়পাড়া গুড়াকমন্ডল সীমান্তে আন্তর্জাতিক প্রধান পিলার ৯২৯-এর সাব পিলার ১ এস থেকে বাংলাদেশের প্রায় ৪০০ গজ ভেতরে এ ঘটনা ঘটে।

পুলিশ, বিজিবি, স্থানীয় প্রশাসন ও উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

জাতীয় দৈনিক আজকের পত্রিকা এর খবর থেকে জানা যায়, দুর্বৃত্তরা ভবেশ চন্দ্র বর্মণের বাড়ির উঠোনে অবস্থিত হরিদেব মন্দির, বিনয় চন্দ্র বর্মণের বাড়ির উঠোনে অবস্থিত মনোসা মন্দির, ধীরেন চন্দ্র বর্মণের বাড়ির উঠোনে অবস্থিত মহাদেব মন্দির এবং রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে হামলা চালায়। এ সময় চারটি মন্দিরের আটটি প্রতিমা ভাংচুর করে দুর্বৃত্তরা।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রখ্যাত আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন , আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাম্প্রতিক জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠানে বলেছেন, আসন্ন দুর্গাপূজা বা তার পরেও দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হতে পারে। এমনকি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন। এটা স্পষ্ট যে রাজনৈতিক দলগুলো আজ একই সুরে কথা বলছে যা আমরা অতীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষয়ে প্রকাশ করেছি ।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বাংলাদেশ যুব ঐক্য পরিষদের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

 শ্রী রানা দাশগুপ্ত বলেন যে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন যে শুধুমাত্র শারদীয় দুর্গাপূজার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক শান্তি-শৃঙ্খলার কথা ভাবা উচিত নয়। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না। সেজন্য সব রাজনৈতিক দলকে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

আসন্ন দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কোনো কর্মসূচি ঘোষণা না করার জন্য তিনি সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানান।

একই সঙ্গে দেশের সংখ্যালঘুদের জনজীবনে যেন অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি না হয়। চার মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই আমরা এ কথা বলে আসছি। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, নির্বাচনের আগের সময়টা আমাদের জন্য ভালো ছিল না।

সম্প্রতি শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা উদযাপন পরিষদের আলোচনা সভায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা নিরাপদ নয়।

তিনি আরও প্রশ্ন তুলে বলেন স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী শক্তি বঙ্গবন্ধুর দল এবং তার সহযোগী বামপন্থী সহ ১৪ দল বিগত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে আমার নেত্রীর নেতৃত্বে দেশ পরিচালনা করার পরে দেশ কেন এত সাম্প্রদায়িক হয়ে গেল?

আগামী সংসদ অধিবেশনে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন পাসের দাবি জানান তিনি। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে সংখ্যালঘুরা একদিন এই দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন নামের দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০১ সালের পর ১৩ বছরে দেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের অন্তত ২০ হাজার ঘটনা ঘটেছে।

অন্যদিকে, দৈনিক যুগান্তর এবং দৈনিক বাংলা ট্রিবিউন যথাক্রমে সংখ্যালঘুদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন কভার করে বলেছে যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসকে) নামের মানবাধিকার সংস্থা, ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ বছরে হিন্দুদের ওপর অন্তত ৩৬৭৯টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫৫১টি বাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এ সময় হিন্দুদের অন্তত ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

প্রতিমা, পূজামণ্ডপ (উপাসনার স্থান) এবং মন্দিরে প্রায় ১৬৭৮ টি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

অতীতে সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার জন্য আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়ের নেতারা একে অপরকে দোষারোপ করেছেন।

কোনো ঘটনারই প্রকৃত বিচার হয়নি। ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে এবং আসছে দুর্গাপূজা ও জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা করছেন।