Tuesday, November 18, 2025
জীবনযাপন

মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোবাসা

প্রেম, ভালোবাসা, পেয়ার, মহব্বত শব্দগুলো শুনলেই প্রেমিক হৃদয়ে দোলা দিয়ে উঠে। যারা কাঙ্খিত মানুষের ভালোবাসা পান তাদের হৃদয়ে সুখের দোলা দেয় আর যারা পান না বা পেয়েও হারিয়ে ফেলেন তাদের হৃদয়ে হাহাকারের সুর বেজে উঠে। আবার কারও হৃদয় ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আকুলতা-ব্যাকুলতার সীমা ছাড়িয়ে কল্পনার রাজ্যে প্রিয়তমার ছবি আঁকেন।

ভালোবাসা কেউ পেয়ে হয় আনন্দে মাতোয়ারা আর কেউ হারিয়ে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। কেউবা হাতে তুলে নেয় মদের বোতল, কেউ কলম। জীবনে নয়া লক্ষ্য নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আবার ভালোবাসা কেউ পেয়ে পস্তায়, কেউ হারিয়ে পস্তায় আবার কেউবা পাওয়ার জন্য শতবার পস্তাতে থাকে।

ভালোবাসা নিয়ে কত কবি, সাহিত্যিক কত গল্প কবিতা রচনা করেছেন। কারও রচনায় ভালোবাসার মধুরতা প্রকাশ পেয়েছে তো কারও রচনায় ভালোবাসার তিক্ততা।

‘সখি ভালোবাসা কারে কয় সেকি কেবলি যাতনা ময়’ আসলেই ভালোবাসার সংজ্ঞা কি? স্কুল জীবনে কোথাও একটা সংজ্ঞা পড়ছিলাম সেটা হল- ‘ভালোমন্দ বিবেচনা না করিয়া, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে, সাগর সমান জলে নেমে যাহা রচিত হয় তাহাই ভালোবাসা।’

মনকে কেন্দ্র করেই ভালোবাসার রং বদলায়। বদলে যায় মানুষের আচরণ থেকে শুরু করে দৃষ্টিভঙ্গি। মন নিয়েই যেহেতু ভালোবাসার বেচাকেনা তাই মনোবিজ্ঞানীরা ভালোবাসা নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন।

মনোবিজ্ঞানীর ভালোবাসার একটি তত্ত্ব হল- 

আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী রবার্ট জে. স্টেনবার্গ (Robert J. Sternberg) ১৯৮৫ সালে ভালোবাসার একটি ত্রিমাত্রিক তত্ত্ব দিয়েছেন যেটা ত্রিকোণ প্রেম তত্ত্ব (Triangular Theory Love) নামে পরিচিত। স্টানবার্গের মতে, আন্তঃব্যক্তিক সম্পকর্কে ভালোবাসা ৩টি ডাইমেনশনের উপর ভিত্তি করে আবর্তিত হয়।

১. অন্তরঙ্গতা: এটার মানে হলো ঘনিষ্টতার অনুভূতি (Feeling of closeness), একাত্বতা (Attachment) এবং সন্তুষ্টির অনুভূতি (Contentedness)। সোজা বাংলায় কাছে থাকার আকুলতা আর ব্যাকুলতার অনুভূতি।

২. আবেগ: তীব্র আকাঙ্খা যেটা আমাদের রোমান্স, শারীরিক আকর্ষণ, যৌন সম্পর্কের দিকে ধাবিত করে।

৩. প্রতিশ্রুতি: জীবনে-মরণে, ঝড় তুফানেও পাশে রবে দু’জনে। মানে হলো সম্পর্কটাকে দীর্ঘমেয়াদে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নেয়ার তীব্র বাসনা, অনুভূতি।

আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী রবার্ট জে. স্টেনবার্গ

এই তিনটিকে স্টেনবার্গ সমসত্ত্ব ও অসমসত্ব মিশ্রন করে স্টেনবার্গ কয়েক রকমের ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়েছেন।

১. নন-লাভ (Non love): মানে কোনও ভালোবাসা নেই। উপরের তিনটি উপাদানের একটিও এখানে নাই। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি আপনাদের সাথে এই মুহূর্তে আমার সম্পর্কটা। আপনারা আমার এই লেখাটা পড়ছেন। আপনাদের সাথে আমার অন্তরঙ্গতা, আবেগ এবং প্রতিশ্রুতি কিছুই নেই।

২. পছন্দ (Liking): এখানে শুধু অন্তরঙ্গতা (Intimacy) থাকে। কাছাকাছি থাকার তীব্র ইচ্ছে থাকে। তবে আবেগ আর প্রতিশ্রুতির কোনও বালাই নেই। আপনার কারও সঙ্গে ঘুরতে ভালো লাগে, ভালো মন্দ শেয়ার করতে ভালো লাগে কিন্তু রোমান্টিকভাবে জড়িত না বা কোনও সম্পর্কে জড়ানোর প্রতিশ্রুতি নেই। আমাদের এ রকম অনেক সম্পর্ক থাকতে পারে যেখানে আমাদের অন্য কারও সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে, তার সঙ্গ উপভোগ করি।

৩. প্রফুল্ল প্রেম (Infatuated love): এখানে শুধু আবেগ থাকে। কিন্তু অন্তরঙ্গতা, প্রতিশ্রুতি থাকে না। তবে এত আবেগ কোথা থেকে আসে। যে আবেগ ভুলে যায় জাতি, কূল ও মান, তোমারে করিব দেহ-মন দান। তো সেই ক্রাশ খাওয়া ভালোবাসা হলো অন্তরঙ্গতা ভালোবাসা। শুধু যৌন সম্পর্ক স্থাপন এ ধরনের ভালোবাসার মধ্যে পড়ে যেহেতু এখানে শুধু জাগতিক সুখ পাওয়ার মধ্যেই চাহিদা সীমাবদ্ধ থাকে অন্যকিছু না।

৪. শূন্য প্রেম (Empty love): এখানে শুধু প্রতিশ্রুতি থাকে। অন্তরঙ্গতা এবং আবেগ থাকে না। ‘ছাড়বো না কবু এ বাঁধন, আসলে আসুক ঝড় তুফান’ কিন্তু ওইদিক প্রিয়তম নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছে।

৫. অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ: শুরু হয় শূণ্য ভালোবাসা দিয়ে। বিয়ে টা হয় আজীবন একে অন্যের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। সময়ের পরিক্রমায় সেখানে আবেগ এবং অন্তরঙ্গতার সমসত্ত্ব একটা মিশ্রণ তৈরি হয়। যার উপর ভিত্তি করে দু’মেরুর ২ জন যুগ যুগ ধরে সুখের সাগরে ঢুবে আর ভাসে, ভাসে আর ডুবে। তবে অসুখী বৈবাহিক সম্পর্কগুলোতে শুধু বৈবাহিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য, সামাজিকতা রক্ষা করার জন্য বা অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। আবার হয়তবা অনেকেই সন্তানদের কথা চিন্তা করে অসুখী বৈবাহিক সম্পর্ক চালিয়ে যায় যেখানে কোনও আবেগ থাকে না।

৬. রোমান্টিক ভালোবাসা (Romantic love): শব্দটা শুনলেই হৃদয়ে দোলা দিয়ে উঠে। তাই বিস্তারিত বলার প্রয়োজন পড়ে না..

৭. লিভ টুগেদার (Live Together): এটি একটি ইংরেজি শব্দ যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় একসাথে থাকা। কিন্তু লিভ টুগেদার শব্দটিকে একটা বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড বিয়ের আগে যখন স্বামী স্ত্রীর ন্যায় একসাথে থাকে তখন তাকে লিভ টুগেদার বলে। এটি আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ। তবে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে এই রীতিটি বেশ চালু রয়েছে। বিয়ের আগে বয়ফ্রেন্ড গা্র্লফ্রেন্ড একসাথে থাকতে শুরু করে। তাদের ধারণা একটি মানুষের সাথে আজীবন থাকার উদ্দেশ্যেই বিয়ে করা হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষটির সাথে মনের মিল হবে কি না তা না থেকে বোঝা যায় না। তাই বিয়ের আগেই তারা প্রিয় মানুষটির সাথে থাকার অভ্যাস গড়ে তোলে। মনের মিল হয়ে গেলে তারপরে তারা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে এমনও দেখা গেছে যে ছেলেমেয়েসহ তারা বিয়ের আসরে বসেন।

৮. সমবেদনা প্রেম (Compassionate Love): এ ধরনের ভালোবাসায় অন্তরঙ্গতা এবং প্রতিশ্রুতি থাকে থাকে কিন্তু কোনও আবেগ থাকে না। এখানে দু’জন ব্যক্তি দু’জনের সঙ্গ উপভোগ করে, সম্পর্কে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কিন্তু সেখানে কোনও রোমান্টিক আবেগ থাকে না।

৯. বোকার প্রেম (Fatuous Love): এখানে আবেগ আর প্রতিশ্রুতির ভরপুর থাকে কিন্তু কোনো অন্তরঙ্গতা থাকে না। বোকার মতো ভালোবাসা, অবাস্তব ভালোবাসাগুলো। বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো টাইপ ভালোবাসাগুলোতে সীমাহীন আবেগ আর জান প্রাণ দিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি থাকে। স্পর্শ করার সুযোগ থাকে না। ‘বনমালি তুমি পর জনমে হইও রাধা’, ‘এ জীবনে না পেলেও দেখা হবে পরজনমে’ এই টাইপের প্রেমগুলো হলো বোকার প্রেম।

পরিপূর্ণ ভালোবাসা (Consummate love): এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন পরিপূর্ণ প্রেমটা কি। স্টেনবার্গের মতে যে সম্পর্কে অন্তরঙ্গতা, আবেগ এবং প্রতিশ্রুতি এই ৩টি উপাদানের সমসত্ত্ব মিশ্রণ ঘটবে সেটাই হলো পরিপূর্ণ ভালোবাসা। যেটা আমরা সবাই পেতে চাই। যেটা পেলে আমাদের জীবন ধন্য হয়ে যাবে। যে ভালোবাসা পেতে আমরা সাত সাগর ১৩ নদী পাড়ি দিয়ে সৈকতে বসে থাকতে রাজি প্রিয় মানুষটির জন্য। যেখানে আমাদের অন্তরঙ্গতা হবে প্রচণ্ড শক্তিশালী সুপার গ্লু আঠার মতো, আবেগ থাকবে সুষম আর প্রতিশ্রুতি থাকবে ইস্পাতের মতো সুদৃঢ়।