Friday, May 17, 2024
সম্পাদকীয়

বাঙ্গালী হিন্দুর প্রতিরোধ দিবস: ইতিহাস ও আমাদের উত্তরাধিকার

————————————————————————–

শৌভিক দত্ত
=========
১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগস্ট। কলকাতার হিন্দুদের জীবনে নেমে এসেছিলো এক নৃশংস জেহাদী আক্রমণ, যার পোশাকি গালভরা নাম ছিলো ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ আর দ্যা স্টেটসম্যান সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়ের সুবাদে ইতিহাসে যা পরিচিত হয়েছে, ‘The great Calcutta killing’ নামে।

এই হিন্দু গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হলে আমাদের ইতিহাসের সময় সারণী বেয়ে যেতে হবে আরেকটু পিছনের দিকে। ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দের ২৩ শে মার্চ লাহোর শহরে মুসলিম লীগ একটি প্রস্তাব পাশ করে। আমাদের কাছে এটা পরিচিত ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে। এতে লেখা ছিলো, ভারতবর্ষের মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলোকে নিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র তৈরী করতে হবে, অর্থাৎ সোজা ভাষায় আমাদের মাতৃভূমিকে ভেঙ্গে দু’টুকরো করে মুসলমানদের আলাদা একটি রাষ্ট্র দিতে হবে। প্রস্তুতি অবশ্য নেওয়া হচ্ছিলো বহু আগে থেকেই। বহু বছর ধরেই পরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত দাঙ্গা হাঙ্গামার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হিন্দু ও শিখদের। বিশেষতঃ, পূর্ব বাংলা‚ মালাবার উপকূল‚ পশ্চিম পাঞ্জাব‚ উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে নিয়মিত হারেই হিন্দু ও শিখরা অন্য অঞ্চলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছিলো নিজেদের প্রাণ ও পরিবারের সম্মান বাঁচানোর জন্য। ফলে সেইসব অঞ্চলে পাকিস্তান সৃষ্টির অনুকূলে জনবিন্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদেরও বিভিন্নভাবে সাহায্য করা হচ্ছিলো স্বাধীনতার সংগ্রাম দমন করার কাজে‚ যাতে পাকিস্তান তৈরির ব্যাপারে হিন্দুদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য পাওয়া যায়। চৌধুরী রহমত আলি ১৯৩৩ সালেই আর কোনো রাখঢাক না রেখেই “নাউ অর নেভার” নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে দাবি তুলে দেয় পৃথক মুসলমান রাষ্ট্র সৃষ্টির। কমিউনিস্ট পার্টিও তাদের বিখ্যাত ‘অধিকারী থিসিস’-এ একপ্রকার সমর্থন দিয়ে দেয় পাকিস্তান সৃষ্টির। গণনাট্যের সদস্য কমরেড হেমাঙ্গ বিশ্বাস পাকিস্তানের পক্ষে লিখেও ফেলেন‚

শোন কংগ্রেস নেতাগণ
মুসলমানের আত্মশাসন
না মানিলে হয় না মিলন
দেখ চিন্তা করি।

আরও লেখেন‚

দীন ইসলামের নিদ্ মহলে হাঁকে ভোরের আজান‚
জাগ্ জাগ্ রে মুসলমান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে যখন একপ্রকার নিশ্চিত হয়েই যায় যে ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করছেই‚ তখন থেকে পাকিস্তান তৈরীর প্রচেষ্টা আরও জোর গতিতে চলতে থাকে। আর তারই সাথে চলতে থাকে মুসলিম লীগের মধ্যে ক্ষমতার জন্য নেতৃত্বদের মধ্যে কামড়াকামড়ি। কারণ যদি পাকিস্তান তৈরী হয়‚ তবে যে নেতা যত উপরের পর্যায়ে থাকবে‚ নতুন রাষ্ট্রে সে তত বড় পদ পাবে। আর এই ক্ষমতার টানাপোড়েন আর ধর্মান্ধতার মেলবন্ধন থেকেই জন্ম নিয়েছিলো কলকাতা তথা পশ্চিম বাঙ্গালার ইতিহাসের অন্যতম বড় হিন্দু গণহত্যাটি।

সেইসময় মুসলিম লীগ ছিলো প্রধানত জিন্নাহর নিয়ন্ত্রণে। আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাঙ্গালার প্রধানমন্ত্রী (তখন প্রদেশের শাসককে ‘প্রধানমন্ত্রী’ নামেই ডাকা হতো) হলেও জিন্নাহর সামনে বিশেষ পাত্তা পাচ্ছিলো না। তাই সেও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো মুসলমানদের কাছে জিন্নাহর থেকেও বড় জেহাদী বলে নিজেকে প্রমাণ করতে। আর এই সুযোগ তাকে এনে দিল খোদ মহম্মদ আলি জিন্নাহ।

এদিকে জিন্নাহও সুযোগ খুঁজছিলো ব্রিটিশ সরকার ও হিন্দুদের সামনে মুসলমানদের পেশীশক্তি প্রদর্শনের। এছাড়াও তাদের স্বপ্নের পাকিস্তানের জন্যে কলকাতা ছিলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শহর-বন্দর। কলকাতার হিন্দুদের সন্ত্রস্ত করে উচ্ছেদ করাতে পারলেই দেশভাগের সময় মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলরূপে কলকাতাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা এমন কিছু কঠিন হবে না তাদের পক্ষে। এর জন্যে দরকার ছিলো একটা ছুতোর। এমন সময় জওহরলাল নেহরু একটি বেফাঁস কথা বলে বসলেন সাংবাদিকদের সামনে। বোকার মতো দম্ভ দেখাতে গিয়ে বললেন যে শাসন পরিষদে দুই দলের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও তারা সংখ্যার জোরে ইচ্ছামতো সমস্ত বিল পাশ করিয়ে নেবেন। আর জিন্নাহও পেয়ে গেলো তার বহু আকাঙ্খিত ছুতোটিকে।

১৯৪৬ সালের ২৯ শে জুলাই বোম্বের (অধুনা মুম্বাই) সভায় জিন্নাহ ডাক দিলো প্রত্যক্ষ সংগ্রামের। বিবৃতি দিল, “কংগ্রেসের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় গণতান্ত্রিক পথে আর এগোনোর সুযোগ না থাকায় আমরা হাতে পিস্তল তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছি। সময় এখন, ডাইরেক্ট অ্যাকশনের।” সভা থেকে ভেসে এলো সরাসরি হুমকি‚ “আমি নীতিকথার আলোচনায় যেতে চাই না। আমাদের হাতে বন্দুক আছে এবং আমরা তা ব্যবহার করতে প্রস্তুত।”

বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী নিজেকে জিন্নাহর থেকে বড় জেহাদী নেতা প্রমাণের এই সুযোগ কিছুতেই ছাড়তে রাজি ছিলো না। এই ১৬ ই আগস্ট দিনটিকেই সে বেছে নিলো নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের। হিন্দু গণহত্যার প্রস্তুতি চলল জোর কদমে। পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব থেকে আগের অফিসারদের সরিয়ে সেখানে আনা হলো মুসলিম লীগের বাধ্য অফিসারদের। ডি-সি হেডকোয়ার্টার থেকে নর্টন জোন্সকে সরিয়ে সেখানে দোহাকে আনা হয়। ডিসি নর্থ রায়বাহাদুর সত্যেন মুখার্জীকে সরিয়ে সেখানে সোহরাওয়ার্দী আনে হাফিজউদ্দীনকে। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (N.W.F.P.) থেকে প্রচুর সংখ্যক মুসলমান পুলিশ আমদানি করা হয়। কোনো কোনো থানায় অতিরিক্ত একজন করে ও.সি.নিয়োগ করা হয়। বিশেষতঃ হিন্দু এলাকা গুলোতে নিয়োগ করা হয় অতিরিক্ত মুসলমান ও.সি.। এছাড়া হিন্দু গণহত্যা সুচারুভাবে পরিচালনা করার জন্য তৈরী হয় ‘মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড’। প্যারামিলিটারি ফোর্সের মতো তাদের পোশাক দেওয়া হয়‚ টুপিও দেওয়া হয়। শোনা যায়, এইসময় সোহরাওয়ার্দী নিজে মুসলমান পাড়ায় গিয়ে পেট্রোল ও অস্ত্রশস্ত্র বন্টন করেছিলো। ১৬ ই আগস্ট থেকে ১৯ শে আগস্ট — এই চারদিন কলকাতার রাস্তায় কোনো পুলিশ বা মিলিটারি দেখা যায়নি। তাদের সবাইকে ব্যারাকে বসে থাকতে হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী সরকারের রাষ্ট্রীয় নির্দেশে। নির্দিষ্ট দিনে সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয় সোহরাওয়ার্দীর পক্ষ থেকে।

 

১৬ ই আগস্ট ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগের সভা। বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র হাতে সেদিন সভায় উপস্থিত ছিলো প্রায় পঞ্চাশ হাজার মুসলমান। মঞ্চে উপস্থিত ছিলো হোসেন সোহরাওয়ার্দী‚ খাজা নাজিমুদ্দিন‚ ইস্পাহানি ও মুসলিম লীগ পন্থী দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। সমর্থকদের উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দী সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়‚ “সেনা ও পুলিশকে সংযত করা হয়েছে। চব্বিশ ঘন্টা সময় দিলাম‚ যা করতে পারিস কর।” সভা শেষ হতেই উপস্থিত মুসলমান জনতা প্রথমে আক্রমণ করে সভা দেখতে আসা হিন্দু জনতাদের। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ – হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে তারা দল বেঁধে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা ধরে। অবাধে চলে লুটপাট‚ খুন জখম‚ ধর্ষন। ক্যানিং স্ট্রিট‚ ওয়েলেসলী স্ট্রিট‚ ধর্মতলা স্ট্রিট‚ কর্পোরেশন স্ট্রিট‚ মানিকতলা রোড আর বিবেকানন্দ রোডে গণলুট হয়। লুট হয় কমলালয় স্টোর্স‚ ভারতকলা ভান্ডার‚ লক্ষ্মী স্টোর্সের মতো বিখ্যাত দোকানগুলো। আক্রান্ত হয় উত্তর ও মধ্য কলকাতার হিন্দু পাড়াগুলি। গড়পাড়‚ নারকেলডাঙা‚ বেলেঘাটা‚ ফুলবাগান‚ পার্ক সার্কাস‚ কলুটোলা‚ চিৎপুর জুড়ে সন্ত্রাস চালিয়ে বেড়ায় ‘মুসলিম লীগার’-রা। আর শুধু সাধারণ মানুষই না‚ তাদের আক্রমণ থেকে বাদ পড়েননি অভিনেতা ছবি বিশ্বাস‚ গণিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্তী‚ রাজা দেবেন্দ্র মল্লিক‚ ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এস.এস.মুখার্জির মতো বিশিষ্ট বাঙ্গালীরাও। আক্ষরিক অর্থেই যেন একখন্ড নরক নেমে আসে কলকাতার বুকে। নিহত হয় অসংখ্য হিন্দু‚ ধর্ষিতাদের সংখ্যা ছিলো অগুনতি। হিন্দুদের উপর বিজয়ের চিহ্ন স্বরূপ রাস্তার পাশে ধর্ষিতা মৃত মেয়েদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়। আক্রমণ চলল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। ভিক্টোরিয়া কলেজের লেডিজ হোস্টেল আক্রমণ করে লীগের গুন্ডারা। অন্যান্য মেয়েরা সময়মতো বাড়িতে পালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত পালাতে পারেনি চারজন ছাত্রী। হোস্টেলেই ছিলো তারা। হতভাগিনীদের উপর গণধর্ষণ চালিয়ে তাদের হত্যা করে আক্রমণকারীরা। ধর্ষণের পর তাদের স্তন কেটে নিয়ে তারপরে তাদের যৌনাঙ্গে গো-মাংস ঝোলানোর শিক ঢুকিয়ে‚ তাদের মৃতদেহগুলিকে কলেজের দোতলার একটি ক্লাসরুম থেকে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো হিন্দুদের মধ্যে ভয় সৃষ্টির জন্য। আর শুধু বাঙ্গালীই নয়‚ হিন্দু হলেই আর ছাড় ছিলোনা কারও। মেটিয়াবুরুজে উড়িয়া শ্রমিকদের বস্তিতে চলে আক্রমণ। কম করে ৫০০ জন উড়িয়া শ্রমিককে সেখানে হত্যা করা হয়েছিলো। অসহায় শ্রমিকদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিলো সেদিন হুগলি নদীর জল। তবে হিন্দুরাও অবশ্য শুধুই পড়ে পড়ে মার খায়নি। হ্যাঁ‚ প্রাথমিকভাবে নিজেদের হাজার বছরের প্রতিবেশীদের তরফ থেকে আসা এমন আক্রমণে তারা হতভম্ব হয়ে যায়। ধর্মনিরপেক্ষতার এতদিনের লালিত বিশ্বাস মূহুর্তের মধ্যে চোখের সামনে ধ্বসে পড়াতে মানসিক বৈকল্য আসে তাদের। পাল্টা প্রতিরোধের জন্যে তৈরী না থাকায় প্রথম দুদিন প্রচন্ড ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় তারা। তবে শেষ পর্যন্ত নিজেদের বীরত্বের ঐতিহ্য বজায় রেখে ঠিকই প্রতিরোধে নামে হিন্দুরা। নেতৃত্ব দেয় স্থানীয় এক মাংস ব্যবসায়ী গোপাল মুখোপাধ্যায়‚ ওরফে গোপাল পাঁঠা। স্থানীয় হিন্দু যুবকদের নিয়ে তৈরী করলেন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ বাহিনী। তার সঙ্গে যোগ দিলেন রাম চ্যাটার্জী, যুগলকিশোর ঘোষ, ইন্দুভূষন, বিজয় সিং নাহার এবং আরও অনেকে। তেমন কোনো অস্ত্র ছিলো না তাদের। বছর খানেক আগে মার্কিন সেনাদের থেকে জোগাড় করা সামান্য কিছু আগ্নেয়াস্ত্র আর হাতের কাছে পাওয়া যৎসামান্য কিছু অস্ত্র নিয়েই জেহাদ প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা।

জেহাদী আক্রমণ প্রতিহত করলেও সেদিন কিন্তু মানবতা হারায়নি হিন্দুরা। কোনো মুসলমান শিশু বা মা-বোনের গায়ে হাত তোলা নিষিদ্ধ ছিলো তাদের জন্য। হিন্দু মতে পরস্ত্রী মানেই যে সে মাতৃতুল্য। কোনো মুসলমান যদি আশ্রয় চায়, তবে তাকে আশ্রয় দিতেও হিন্দু প্রতিরোধ বাহিনী ছিলো বাধ্য। কিন্তু কোনো অস্ত্রধারী আক্রমণকারীকেই জীবন্ত ছাড়া যাবে না। সহযোদ্ধাদের প্রতি এটাই ছিলো নেতা গোপাল পাঁঠার স্পষ্ট নির্দেশ। দু-তিন দিন ধরে চলে প্রবল প্রতিরোধ। সেই প্রতিরোধের ব্যাপকতা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সোহরাওয়ার্দী ও অন্যান্য মুসলিম লীগের নেতারা। বাঙ্গালী হিন্দুদের থেকে এমন প্রতিরোধ আসবে, তা তারা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। একের পর এক হিন্দু এলাকা দখলমুক্ত হয়। কলকাতা থেকে হঠতে থাকে মুসলিম লীগ। পরিস্থিতি দেখে ভয় পেয়ে যায় সোহরাওয়ার্দী! এইভাবে চলতে থাকলে যে কলকাতা তো কোন ছাড়‚ গোটা বাঙ্গালা থেকেই যে লীগের নাম মুছিয়ে দেবে বাঙ্গালী হিন্দুরা। ফলে একদিন যে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে আটকে রাখা হয়েছিল লীগের গুন্ডাদের অবাধে সন্ত্রাস করার জন্য‚ সেই সেনাবাহিনীকেই এবার লাগানো হলো হিন্দু প্রতিরোধ বাহিনীর বিরুদ্ধে। ফলে ২০ তারিখ থেকে শান্ত হয়ে আসে কলকাতা। তবে ততক্ষণে জিন্নাহর কলকাতা দখলের স্বপ্ন আক্ষরিক অর্থেই ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে গোপাল পাঁঠা ও তার সহযোদ্ধারা। কতজন বাঙ্গালী হিন্দু নিহত হয়েছিলেন সেই জেহাদী আক্রমণে? সঠিক হিসাব এখনো অজানা। সরকারি মতে, তিন হাজার। প্রত্যক্ষদর্শীদের ও বেসরকারি মতে, সংখ্যাটি অন্ততঃ কুড়ি হাজার। এছাড়া গনধর্ষণ‚ লুট ইত্যাদি তো আছেই। অগনিত ধর্ষণ ও হত্যার ফলে স্রেফ শেষ হয়ে গিয়েছিলো বহু পরিবার। বাঙ্গালী হিন্দুর অর্থনীতি ধ্বসিয়ে দেওয়ার জন্য লুটপাট ছিলো তাদের অত্যন্ত কার্যকরী একটা অস্ত্র। কেবলমাত্র কমলালয় স্টোর্স থেকেই তৎকালীন সময়ের হিসাবেই প্রায় লক্ষাধিক টাকার জিনিস লুট হয়। তাহলে পুরো কলকাতা থেকে কি পর্বত পরিমাণ অর্থ লুট হয়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়।

এই কলকাতা গণহত্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতপার্থক্য হয়তো থাকতেই পারে। থাকতে পারে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিতর্কও। তবে সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধে উঠে এটাই বলা যায় যে‚ এই গনহত্যার বিরুদ্ধে বাঙ্গালী হিন্দুর স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ তার চিরকালীন ঐতিহ্যকেই বজায় রেখেছিলো। বাঙ্গালী হিন্দু শান্তিপ্রিয় জাতি‚ কখনোই নিজে থেকে কাউকে আক্রমণ করে না সে‚ কারও উপর অত্যাচার করে না। কিন্তু কেউ তাদের সাথে তা করলে‚ তারা সেই অত্যাচারকে প্রতিহত করার জন্যে মৃত্যু পণ করেও লড়তে পারে। গোপাল পাঁঠা ও তার প্রতিরোধ বাহিনী ছিলো এই চিরন্তন ঐতিহ্যেরই স্বার্থক রক্ষাকর্তা। বাঙ্গালী হিন্দুর এই ৭৪ তম প্রতিরোধ দিবসে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে জাতির বিপদে আমরা কেউই নিস্পৃহ থাকবো না। জাতি আক্রান্ত হলে‚ বিজাতীয় শত্রুদের দ্বারা তার অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়লে আমরা প্রত্যেকেই একেক জন গোপাল পাঁঠা হয়ে উঠে‚ নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও জাতিকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাবো। তাদের লড়াকু উত্তরাধিকারকে আমরাই বহন করে পৌঁছে দেবো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এটাই হোক আজকের দিনে আমাদের গৈরিক শপথ।

(লেখক- শৌভিক দত্ত। মতামত লেখকের নিজস্ব)