Tuesday, April 16, 2024
শিক্ষাঙ্গন

বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে যামিনী রায়ের অবদান

যামিনী রায় ১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামের এক মধ্যবিত্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামতরণ রায়। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি চিত্রশিল্পী। তিনি বাংলার বিখ্যাত লোকচিত্র কালীঘাট পটচিত্র শিল্পকে বিশ্বনন্দিত করে তোলেন। তিনি নিজে পটুয়া না হলেও নিজেকে পটুয়া হিসেবে পরিচয় দিতেই তিনি পছন্দ করতেন।১৯১৮-১৯ থেকে তাঁর ছবি ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টের পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।

১৯০৬ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতিতে পড়াশোনা করেন। আর্ট স্কুলে ইতালীয় শিল্পী গিলার্দি ও পরে অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউনের সংস্পর্শে এসে তিনি প্রাচ্য-প্রতীচ্যের উভয় শিল্পের কলা-কৌশলের সাথে পরিচিত হন। ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতি শিখলেও শেষ পর্যন্ত দেশজ সরল রীতিতে চিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়া কিছুদিন তিনি ফার্সি শিল্পীদের মতো চিত্র চর্চা করেন। এইসময় তিনি তার চিত্র চর্চার বেগ আরো বৃদ্ধি করেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে কলকাতা আর্ট কলেজে চিত্র চর্চার জন্য ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯১৪ সালে ফাইন আর্টে ডিপ্লোমা করেন।

বিদেশি ভাবধারায় প্রথম দিকে ছবি আঁকলেও পরবর্তীতে সম্পূর্ণ দেশীয় তথা গ্রামবাংলার প্রতিরূপ তার ছবিতে ফুটে উঠেছে। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তার লক্ষ্যে তিনি লোক ও নৃগোষ্ঠীদের সংস্কৃতি বেছে নেন। নিজস্ব বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাবধারার জন্য তিনি গর্বিত ছিলেন। তিনি বহুবার বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ পেলেও কখনও বিদেশে যাননি।

ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতিতেই চিত্রকলায় শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। আর্ট স্কুলের বিখ্যাত শিল্পীদের সান্নিধ্যে এসে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের উভয় শিল্পের কলাকৌশলের সাথে পরিচিত হন। পাশ্চাত্য রীতির চিত্রকলা তাকে আকৃষ্ট করে এবং ফলস্বরূপ তিনি তাতে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী পল সেজান, ভ্যান গগ, পাবলো পিকাসো ও গগ্যাঁর প্রভাব দেখা যায় তাঁর চিত্রকলায়।

তার স্টাইল ও মাধ্যম ছিল পোট্রেইট, ল্যান্ডস্কেপ এবং তৈলচিত্র। এছাড়াও ক্লাসিক্যাল ন্যুড পেইন্টিংয়ে তার হাত ছিল প্রশংসনীয়। নিজস্ব ঢঙে তিনি এঁকে গিয়েছেন তার মতো করে। ছাত্রাবস্থায় তিনি শিক্ষকদের নজরে আসেন। কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ, ভারতের আধুনিক চিত্রকলার অগ্রপথিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় শিষ্য হয়ে উঠছিলেন তিনি দিনে দিনে। হঠাৎই তিনি পাশ্চাত্য শিল্পে আগ্রহ হারাতে থাকেন, যেন হাঁপিয়ে উঠছেন পরসংসস্কৃতি চর্চায়। এরপর তার আঁকার বৈশিষ্ট্য, ধরন, বিষয়বস্তু, তুলির ব্যবহার ক্রমেই বদলাতে থাকে।

কলকাতার কালীঘাটের পটশিল্পীদের চিত্রে তিনি আকৃষ্ট হন। কালীঘাট চিত্রকলা অর্থাৎ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরে কালীঘাটের কালীমন্দিরের সন্নিহিত এলাকার মন্দিরকে কেন্দ্র করে হাট-বাজার গড়ে উঠেছিলো। কালীমন্দিরে যে তীর্থযাত্রীরা আসতেন, ফেরার পথে স্মারক হিসেবে স্মৃতিচিহ্নমূলক বস্তু সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কালীঘাটের কালীমন্দিরের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে স্মারক হিসেবে কালীঘাট চিত্রকলার উদ্ভব ঘটেছিল। চিত্রকলার বিষয় ছিল পৌরাণিক, ধর্মীয় অথবা পশুপাখি জাতীয় গ্রামীণ চিত্র। এগুলোই স্থানীয়রা নিজস্ব রঙে-ঢঙে আঁকতেন, যা কালীঘাট চিত্রকলা নামে বিখ্যাত ছিল। এমন করে শুধু কালীঘাট নয়, জন্মস্থান বেলিয়াতোড়, ওড়িষ্যা, প্রাচীন গুজরাট, মেদিনীপুর ঝাড়গ্রাম থেকেও প্রচুর পট সংগ্রহ করেন যামিনী রায়।

শিল্পীজীবনের প্রারম্ভে ইউরোপীয় ছবির আদলেই ছবি আঁকলেও শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতির আড়ম্বরপ্রিয়তা পরিহার করে দেশজ সরল রীতিতে চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন যামিনী রায়। বাংলার লোকজ পুতুল, শিশুদের আঁকা চিত্র ইত্যাদি তিনি তাঁর ছবির ‘ফর্ম’ হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি বিষয় হিসেবে বেছে নেন গ্রাম বাংলার সরল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখর চিত্র, ধর্মাশ্রয়ী কাহিনী যেমন- রামায়ণ, শ্রীচৈতন্য, রাধা-কৃষ্ণ ও যীশু। এছাড়া বেলিয়াতোড় গ্রামের আশেপাশের গ্রামগুলির সাঁওতালদের জীবনের চিত্ররূপ ‘সাঁওতাল জননী ও শিশু’, ‘মাদলবাদনরত সাঁওতাল’, ‘নৃত্যরত সাঁওতাল’ ইত্যাদি। বর্ণাঢ্য রঙ ওছন্দোময় রেখার ঐকতানের মাধ্যমে তিনি তাঁর চিত্রে এক নিজস্ব ভাবের উন্মেষ ঘটান।

১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটে যামিনী রায়ের ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়। সে সময় পরিচয় নামক কলকাতার এক ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর শিল্পকৃতির আলোচনা হওয়ার ফলে তাঁর ছবি পরিচিতি লাভ করে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে আগত মার্কিন সৈনিক ও অফিসারবৃন্দ যামিনী রায়ের নয়নাভিরাম চিত্র দেখে তা অধিক মূল্যে ক্রয় করার ফলে তাঁর ছবির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। গ্রাম-বাংলার পটুয়াদের শিল্পকর্মের মতো ধনী-নির্ধন সবার কাছে যাতে তাঁর চিত্র সহজলভ্য হয় সেজন্য শিল্পি যামিনী রায় অসংখ্য চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর চিত্র স্বল্পমূল্য ও সহজলভ্য করার জন্য পটুয়াদের মতো তিনি তাঁর চিত্রে দেশজ উপাদান যেমন- ভূষোকালি, খড়িমাটি, বিভিন্ন লতাপাতার রস থেকে আহরিত রং ব্যবহার করতেন। পটচিত্রের আদলে নির্মিত প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর যামিনী রায়ের চিত্র আজও শিল্পামোদী, এমনকি চিত্রবিমুখ সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

যামিনী রায়ের আঁকা বিখ্যাত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘সাঁওতাল মা ও ছেলে’, ‘চাষির মুখ’, ‘পূজারিণী মেয়ে’, ‘কীর্তন’, ‘বাউল’, ‘গণেশ জননী’, ‘তিন কন্যা’, ‘যিশুখ্রিষ্ট’, ‘কনে ও তার দুই সঙ্গী’ ও ‘ক্রন্দসী মাছের সাথে দুই বেড়াল’। ১৯৫৪ পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৬ সালে তাঁকে ডি-লিট প্রদান করেন।