‘অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেবে ভারত’, এটা কি শুধুই ‘প্রতিশ্রুতি’ ?
২০১৮ সালের ১১ আগস্ট মেয়ো রোডের জনসভা থেকে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে বিজেপির অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন অমিত শাহ। তিনি বলেছিলেন, অসমে এনআরসি তো হবেই, হবে বাংলায়ও। তবে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাবে অমিত শাহ সেদিন সীমারেখা টেনে দিয়ে ছিলেন ‘শরণার্থী’ ও অনুপ্রবেশকারী’দের মধ্যে।
আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন অমিত শাহ। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করার অভিযোগ তুলে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘‘মমতাজি, ভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ করে দিন।’’
এনআরসির পক্ষে চড়া স্বরে সওয়াল করে অমিত শাহ সুকৌশলে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, বাংলাদেশ থেকেই আসুন বা অন্য দেশ থেকে, এনআরসি নিয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। ‘শরণার্থী’ আর ‘অনুপ্রবেশকারী’র বিভাজনটা আরও স্পষ্ট করে সেদিন তুলে ধরেছিলেন তিনি।
অমিত শাহ বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে যত শরণার্থী রয়েছেন, তাঁদের সবাইকে আমি আশ্বস্ত করছি, এক জন শরণার্থীকেও বার করা হবে না। তিনি বলেছিলেন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষরা ভারতে এসেছেন, তাঁরা সকলেই শরণার্থী। এঁদের সকলকে নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য বিলও তৈরি হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে অমিত শাহ মন্তব্য করেছিলেন— ভ্রান্তি ছড়াবেন না।
এরপর ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সংখ্যালঘু অমুসলিম উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দিতে লোকসভায় নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন এনে বিল পাস করা হয়।
বিলটির পক্ষে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছিলেন, নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন বিলটি সাধারণ মানুষের জন্য হবে সুরক্ষাকবচ। বিলটি শুধুমাত্র অসমের জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং ভারতের সব কটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য হবে। তিনি বলেন, নির্যাতনের শিকার মানুষের বোঝা ভারত বহন করবে। ভারত ছাড়া ওদের আর যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। গুজরাট, রাজস্থান, দিল্লির মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের উদ্বাস্তুদের স্বস্তি দেবে এই বিল।
বিলে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তুদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ওই অমুসলিম উদ্বাস্তুদের এই আইনের আওতায় আবেদন করতে হবে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আসা সংখ্যালঘু অমুসলিম উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেবেন।
১৯৫০ সালের ৮ এপ্রিল স্বাক্ষরিত নেহরু-লিয়াকত চুক্তিতে বলা হয়েছিল, স্ব স্ব দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হলে যে দেশে তাঁরা প্রবেশ করবেন সেই দেশে তাঁদের শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী, পূর্ব বাংলা থেকে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে আসা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষদের শরণার্থী হিসাবে গণ্য করতে হবে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে কোনও মুসলমান ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে ভারতে আসেননি, এসেছেন অন্য কারণে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ অথবা উপরোক্ত দুটি চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত মুসলমানরা তাই অনুপ্রবেশকারী।
তাহলে নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি অনুযায়ী হিন্দুদের জন্য ভারতের দরজা সব সময়ে খোলা থাকার কথা। তবে কেন বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা হিন্দুদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করা হবে? কেন ‘বহিরাগত’ বলা হবে?
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার একটা বড় অংশই পূর্ববঙ্গ (বর্তমানে বাংলাদেশ) থেকে আসা। বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের মানুষেরা ধর্মীয় কারণেই অত্যাচারিত হয়েছেন, দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে তাঁদের। রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ অনুযায়ী তাঁরা শরণার্থী। ফলে এনআরসি ইস্যু অত্যন্ত সংবেদনশীল চেহারা নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। শনিবার অসমে চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা তৈরি করে ১৯ লাখ নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। বাংলাতেও এনআরসি চাই বলে বিজেপি সুর চড়াচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে চিন্তিত পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত বহু অমুসলিম শরণার্থী।