ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক ১২টি মহামারী
আজ ১০ এপ্রিল, ২০২০ করোনা ভাইরাসে সারা বিশ্বে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৯৭ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে ১৬ লাখেরও বেশি মানুষ এবং এই মহামারি সামাল দিতে প্রায় সব দেশই হিমশিম খাচ্ছে। ভারতে এই মারনব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭৬১ জন এবং মারা গিয়েছেন ২৭৬ জন। ভারত-সহ সারা বিশ্বেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০২০ সালের ১১ই মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) ব্যাধিটিকে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
মহামারী: যখন কোনও রোগ বিশ্বের বিরাট অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং অস্বাভাবিক সংখ্যায় মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় তখন তাকে মহামারী বলে ঘোষণা করা হয়। আজকে আমরা করোনা ছাড়াও ইতিহাসের ভয়ংকর ৫টি মহামারী সম্পর্কে জেনে নেব।
১. স্প্যানিশ ফ্লু: এটি আবার ১৯১৮ ফ্লু মহামারী হিসাবেও পরিচিত। ১৯১৮ থেকে ১৯২০ অবধি এটি ৫০ কোটি মানুষের মাঝে ছড়িয়েছিল।আনুমানিক ১.৭ থেকে ৫ কোটি বা কোন কোন হিসাবে ১০ কোটির মত মানুষ এতে মারা গিয়েছিল। এটিকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক মহামারী হিসাবে দেখা হয়।
২. কলেরা: এটি একটি সংক্রামক রোগ যা পাশ্চাত্যে এশীয় কলেরা নামেই বেশি পরিচিত। ভিব্রিও কলেরী নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে যার প্রধান উপসর্গ মারাত্মক উদরাময়, মুহূর্মহু প্রচুর জলের মত পাতলা পায়খানা, সঙ্গে পেটব্যথা, জলাভাবে শারীরিক দৌর্বল্য এবং চিকিৎসা না হলে শেষপর্যন্ত দেহে জলাভাবের ফলে মৃত্যু।
১৮১৭ সালে রাশিয়ায় প্রথম কলেরা মহামারী রূপে দেখা দেয়। সেখানে কলেরায় প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। স্পেন, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চিন, জাপান, ইতালি, জার্মানি, ভারত ও আমেরিকাতেও কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল মহামারি আকারে। ওই সময় সব মিলিয়ে ২২ থেকে ২৩ লাখ লোক মারা গিয়েছিল কলেরায়। পরবর্তী আরও দেড়শো বছর ধরে কলেরা বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল।
৩. গুটিবসন্ত: গুটিবসন্ত গুটিবসন্ত (Smallpox) মানবদেহের একটি ছোঁয়াচে রোগ। এটি শুধু মানুষেরই হয়ে থাকে। ভ্যারিওলা মেজর বা ভ্যারিওলা মাইনর নামের দুই প্রজাতির ভাইরাসের যেকোন একটির সংক্রমনে এই রোগ হয়। গুটিবসন্তই প্রথম মহামারী, একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যার ইতি ঘটেছিল। গুটিবসন্ত মহামারি হিসেবে দেখা দেওয়ার প্রায় শতাব্দীকাল পর এডওয়ার্ড জেনার নামের একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক গুটিবসন্তের টিকা তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেন। তাঁর দেখানো পথ ধরেই গুটিবসন্তের কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা খুব দীর্ঘ ছিল। অবশেষে ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পৃথিবীকে গুটিবসন্তমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করে।
৪. এইচআইভি/এইডস: এইচ.আই.ভি. (HIV; Human Immunodeficiency Virus হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস) বা মানব প্রতিরক্ষা অভাবসৃষ্টিকারী ভাইরাস লেন্টিভাইরাস (Lentivirus) গোত্রের অন্তর্গত এক ধরনের ভাইরাস যার সংক্রমণে মানবদেহে এইডস (AIDS) রোগের সৃষ্টি হয়। মূলত এইডস একটি রোগ নয়, এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব জনিত নানা রোগের সমাহার। এইচ.আই.ভি ভাইরাস মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (অনাক্রম্যতা) নষ্ট করে দেয়, ফলে নানা সংক্রামক রোগ ও কয়েক রকম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রোগী মৃত্যু মুখে ঢলে পড়ে। ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম এই ঘাতক রোগটি শনাক্ত করা হয়। হু’র মতে এইডসের উৎপত্তি থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছেন।ইউনিসেফ জানিয়েছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ এইডসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন গড়ে ৮০ জন কিশোর-কিশোরী মারা যাবেন।
৫. সার্স: ২০০৩ সালে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল সার্স (SARS) নামের এক সংক্রামক ভাইরাস। সার্সে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৮ হাজারেরও বেশি লোক এবং ১৭টি দেশে মৃত্যু হয়েছিল ৭৭৪ জনের। ‘সিভিয়ার একিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম’ বা সার্স নামের এই রোগের খবর প্রথম বেরোয় ২০০৩ সালে। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল। ছয় মাসের মধ্যেই এ রোগে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়, আর বেশির ভাগ মৃত্যুই হয় পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার কয়েকটি দেশে কয়েক লক্ষাধিক মানুষ এটির দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞান দ্রুত কাজ শুরু করলে মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারেনি। ৬ মাসের মধ্যেই গোটা বিশ্বে সার্স নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
৬. স্মলপক্স এপিডেমিক অব ইন্ডিয়া: ১৯৭০ সালে ভারতে হঠাৎ মহামারী আকারে দেখা দেয় গুটি বসন্ত। এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়ে এক বছরেই মৃত্যুবরণ করে ২০ হাজারের বেশি মানুষ। যখন বিশ্ব প্রায় গুটি বসন্ত মুক্ত হয়ে গেছে, তখন ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এরূপ মহামারী ছিল বেশ হতাশাজনক। পরবর্তী কয়েক বছরে ভারত সরকার এবং জাতিসংঘের সহায়তায় গঠিত একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালেই ভারতকে গুটি বসন্ত মুক্ত ঘোষণা করে।
৭. দ্য পোলিও এপিডেমিক: ১৯১৬ সালে পোলিও রোগ প্রথম মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর থেকে পোলিও’র প্রাদুর্ভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সে বছর নিউইয়র্কে ৯,০০০ মানুষ পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিল এবং ৬,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। এ ছাড়া প্রতিবছর বিশ্বে কত শত মানুষ পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তার কোনও সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না। অবশেষে ১৯৫০ সালে জোনাস সাল্ক পোলিও টিকা আবিষ্কার করলে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ কমে যায়।
৮. দ্য প্লেগ অব এথেন্স: খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে স্পার্টানদের সাথে গ্রিকদের যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিল না গ্রিকরা। তখনই হঠাৎ করে দেখা দেয় পৃথিবীর প্রথম প্লেগ মহামারী ‘দ্য প্লেগ অব এথেন্স’। এই মহামারীতে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানেই হাজার হাজার গ্রিক সৈন্য মারা যায়।
৯. দ্য থার্ড প্লেগ প্যানডেমিক: ১৯ শতকে চিনের ইউয়ান নামক একটি ছোট্ট গ্রামে প্রথম এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ক্রমে তা বিস্তার লাভ করতে করতে হংকং আর গুয়াংঝু প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে, যে শহরগুলোর সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। ফলে প্লেগ ছড়িয়ে যায় ভারত, আফ্রিকা, ইকুয়েডর, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও। প্রায় দুই দশক স্থায়ী এ মহামারীতে প্রাণ হারায় ১ কোটির অধিক মানুষ। কোনও কোনও ইতিহাসবিদের মতে, মৃতের সংখ্যাটা দেড় কোটির বেশি।
১০. দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তেই এর সূচনা হলেও মহামারী আকারে বিস্তার ঘটে ১৯১৯ সালেই। অল্প সময়ের মাঝেই সমগ্র বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ে ইনফ্লুয়েঞ্জায়। ৪ বছরের অধিক সময় বিস্তৃত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেখানে ২ কোটির মতো মানুষ প্রাণ হারায়, সেখানে মাত্র এক বছরেই ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক কেড়ে নেয় ১ কোটিরও বেশি মানুষের প্রাণ।
১১. দ্য ব্ল্যাক ডেথ: ব্ল্যাক ডেথ তথা কালো মৃত্যু বা কালো মড়ক মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি বীভৎস, অমানবিক ও কালো ইতিহাস বহন করছে। পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে পড়া এই মহামারির কবলে পড়ে ১৩৪৬-১৩৫৩ সালের মধ্যে ইউরোপ এবং এশিয়া মহাদেশের (ইউরেশিয়া) ৭৫ থেকে ২০০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ইউরোপের ইতিহাসে ব্ল্যাক ডেথের মতো আলোচিত মহামারী আর নেই। এই অভিশপ্ত মহামারীর প্রভাব টিকে ছিল অন্তত ২০০ বছর। ইতিহাসবিদগণের মতে, এ ২০০ বছরে অন্তত ১০ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
১২. করোনা: এই ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৬ লাখের বেশি মানুষ। আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। করোনা ভাইরাসে সারা বিশ্বে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৯৭ হাজারেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন।