Thursday, March 28, 2024
সম্পাদকীয়

নেতাজির জীবনাদর্শ ও ভারতবোধ

কলকাতা ট্রিবিউন ডেস্ক:

~ পিন্টু সান্যাল

শ্রী অরবিন্দ যখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে অবসর নিয়ে যোগসাধনার জন্য পন্ডিচেরীতে গেলেন সেই সময় ১৩ বছরের সুভাষ কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র।১৯১২ সালে কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সী কলেজে এসে শুনলেন অরবিন্দের কথা।

১৯২১ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে কৃতকার্য হয়েও, ইংরেজের চাকরি ছেড়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিতে সুভাষচন্দ্রের তখনও ৯ বছর বাকি।এই ৯ বছরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে শ্রী অরবিন্দের শূন্যতা পূরণ হয় নি। ছোটোবেলা থেকেই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের আদর্শে বিশ্বাসী কিশোর সুভাষ, স্বাভাবিকভাবেই যুবক বয়সে স্বাধীনতা লাভের পন্থা হিসেবে শ্রী অরবিন্দের আদর্শেই বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। অরবিন্দ ভারত রাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের যে যোগসূত্রকে উপলব্ধি করেছিলেন; ভারতবর্ষের সংস্কৃতির যে প্রাণকেন্দ্রকে চিহ্নিত করে দেশবাসীকে স্বাধীনতালাভের জন্য প্রাণপণ লড়াইয়ের যে আহ্বান করেছিলেন তার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের চিন্তাধারা অভিন্ন ছিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা শুধু ভারতীয়দের মানবাধিকার নয় ,তার এক বৃহত্তর উদ্দ্যেশ্য আছে , ভারতবর্ষের একটা ‘mission’ আছে যার জন্য ভারতীয় সভ্যতা এত বৈদেশিক আক্রমণ সত্ত্বেও বেঁচে আছে। ১৯২৭ সালে লেখা এক চিঠিতে সুভাষচন্দ্র বলছেন

“ভারতীয় জাতি একাধিকবার মরেছে–কিন্তু মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করেছে। তার কারণ এই যে, ভারতের অস্তিত্বের সার্থকতা ছিল এবং এখনও আছে। ভারতের একটা বানী আছে যেটা জগৎ-সভায় শুনাতে হবে ; ভারতের শিক্ষার(culture) মধ্যে এমন কিছু আছে যাহা বিশ্বমানবের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং যা গ্ৰহণ না করলে বিশ্বসভ্যতার প্রকৃত উন্মেষ হবে না।”

বিশ্বসভ্যতার উন্মেষের জন্য যে ভারতবর্ষ কে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে আপোসহীন সংগ্ৰামে নেমেছিলেন ‘দেশনায়ক’ ; সেই দেশকে, দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে কি ছিল সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি? এর উত্তর আমরা পাই , সুভাষচন্দ্রের নিজের কথায় ‘In order to understand india, however, it is essential to bear in mind at the outset two important facts. Firstly, the history of India has to be reckoned not in decades or in centuries,but in thousands of years.’ অর্থাৎ ভারতবর্ষকে বুঝতে তিনি ভারতের কয়েকহাজার বছরের সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিই দৃষ্টি দিতে বলেছেন। ভৌগলিক , নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবর্ষের অসীম বিভিন্নতাকে সহজে চোখে পড়লেও ভারতের বিভিন্ন বর্ণ,ভাষা,পরিধান ও অভ্যাসকে অতিক্রম করে যে ঐক্যসূত্র ভারতবর্ষকে এক অখন্ড সত্ত্বা হিসেবে বেঁধে রেখেছে তা হচ্ছে সনাতন ধর্ম। সুভাষচন্দ্রের কথায়

“সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐক্যসূত্র হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। উত্তর বা দক্ষিণ, পূর্ব বা পশ্চিম, যেখানেই আপনি ভ্রমণ করুন না কেন, আপনি একই ধর্মীয় ধারণা, একই সংস্কৃতি এবং একই ঐতিহ্য পাবেন। সমস্ত হিন্দু ভারতকে পবিত্র ভূমি হিসাবে দেখে। পবিত্র নগরীর মতো পবিত্র নদীগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। যদি একজন ধার্মিক হিন্দু হিসাবে আপনাকে আপনার তীর্থযাত্রা শেষ করতে হয়, আপনাকে দক্ষিণতম প্রান্তে সেতুবন্ধ-রামেশ্বর এবং উত্তরে তুষারাবৃত হিমালয়ের বক্ষে বদ্রীনাথে যেতে হবে।

যে মহান গুরুরা দেশকে তাদের বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন তাদের সর্বদা সমগ্র ভারত ভ্রমণ করতে হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শঙ্করাচার্য, যিনি খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, চারটি ‘আশ্রম’ (মঠ) তৈরি করেছিলেন যা আজও সমৃদ্ধশালী। সর্বত্র একই ধর্মগ্রন্থ পড়া এবং অনুসরণ করা হয় এবং আপনি যেখানেই ভ্রমণ করুন না কেন মহাকাব্য; মহাভারত ও রামায়ণ, সমানভাবে জনপ্রিয়” ।[The most important cementing factor has been the Hindu religion. North or South, East or West, wherever you may travel, you will find the same religious ideas, the same culture and the same tradition. All Hindus look upon India as the Holy Land. The sacred rivers like the sacred cities are distributed all over the country. If as a pious Hindu you have to complete your round of pilgrimage, you will have to travel to Setubandha-Rameswara in the extreme south and to Badrinath in the bosom of the snow-capped Himalayas in the north.

The great teachers who wanted to convert the country to their faith had always to tour the whole of India and one of the greatest of them, Shankaracharya, who flourished in the eighth century A.D., built four ‘Ashramas’ (monasteries) in four corners of India, which flourish to this day. Everywhere the same scriptures are read and followed and the epics, the Mahabharata and the Ramayana, are equally popular wherever you may travel.]

ঋষি অরবিন্দ কারামুক্তির পর বিখ্যাত উত্তরপাড়া অভিভাষণে সনাতন ধর্ম ও জাতীয়তাকে সমার্থক বলেছিলেন। অসুস্থ সুভাষচন্দ্র রাজনৈতিক নির্বাসন নিয়ে ১৯৩৩ সালের মার্চে ইউরোপে যান এবং সেইসময় তাঁর লেখা ‘The indian Struggle’ এ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত রূপ বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। ভারতবর্ষের অখন্ডতা নিয়ে সন্দিহান সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে নেতাজীর স্পষ্ট জবাব ‘Only through ignorance or through prejudice could one assert that under British rule India began to experience for the first time what political unity was.’

রোমা র’লা তাঁর অভিনন্দন বার্তায় জানিয়েছিলেন ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জানতে হলে এই বই অপরিহার্য।ঐতিহাসিকের মহত্তম গুণ আপনার লেখায় ফুটে উঠেছে ‘। শ্রীকৃষ্ণ রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে ধর্মপথে এগিয়ে যেতে শুনিয়েছিলেন উপনিষদের সার ‘গীতা’র বাণী আর সুভাষচন্দ্র ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বকে শোনালেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে স্বদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। ইংরেজদের পরাধীনতা ভারতবর্ষের মানুষ কখন অনুভব করেছিল ? কি কারণে ভারতীয়রা প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে? সুভাষচন্দ্রের উত্তর

‘In the meantime British missionaries had been active in trying to impart their culture and their religion to the Indian people. Out Of these different sources there arose a consciousness on the part of the Britishers Of a cultural or civilising mission in India. It was this which produced the first revolt among the Indians.'[The indian Struggle]। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের ভূমি নিজের সংস্কৃতির , জীবনপদ্ধতির উপর আঘাতের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ প্রথম স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল।

শুধু চিন্তাধারাই নয় , অরবিন্দের কর্মপন্থার সঙ্গেও সুভাষচন্দ্র বসুর মিল লক্ষণীয়। একদিকে কংগ্রেসের ভেতরে প্রয়োজনীয় সংস্কারের চেষ্টা করে ‘নরম’ কংগ্রেস কে ‘গরম’ করা আর অন্যদিকে কংগ্ৰেসকে স্বাধীনতার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনকে উৎসাহ দান।১৯৩৪ সালে ইউরোপে নির্বাসিত সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বের স্বাধীনতা আন্দোলন , তৎকালীন ইউরোপের ইতিহাস ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে তুলনা করে উপলব্ধি করেছেন, অহিংসবাদের প্রতি অযৌক্তিকভাবে ঝুঁকে থাকার কারণেই ভারতবর্ষ দুর্বল হয়ে পড়েছে আর অহিংসবাদের সীমাহীন প্রয়োগের ফলেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছে না।১৯২১ সালে দেশবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতা সংগ্ৰামের জন্য নিজেকে সঁপে দিতে দেশে ফিরে গান্ধীজির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই নেতাজী দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে গান্ধীজিকে প্রশ্ন করেন। কিন্তু সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর বাস্তববাদী নেতাজীকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি।স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দের আদর্শে বিশ্বাসী সুভাষচন্দ্র জানতেন ক্ষাত্রতেজের বিকাশের মাধ্যমেই ঘোর তামসিকতায় নিমগ্ন জাতির পুনর্জাগরণ সম্ভব।দুর্বলের অহিংসার মূল্য কেউ দেয় না। তাই তো মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নির্দেশনায় একের পর এক আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে আর তার সঙ্গে বেড়েছে রাজনৈতিক বন্দী ও আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের অত্যাচার।কংগ্ৰেসে নিজের শুরুর দিনে যুব কংগ্রেসের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে সেনাবাহিনীর পোশাকে সুসজ্জিত প্রায় ২০০০ জন তরুণ ও ৫০০ জন তরুণীর সম্মিলিত কুচকাওয়াজে সামরিক কায়দায় সভাপতিকে অভিবাদন জানিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভারতবর্ষকে শৃঙ্খলমুক্ত করার পন্থা।গঠন করেছিলেন ‘বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স’ যার G.O.C তিনি নিজে। বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সহায়তায় , সুভাষচন্দ্রের তৈরি করা বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স পরবর্তীকালে দেশের বিপ্লবী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। একদিকে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন আর অন্যদিকে কংগ্রেসের রাজনৈতিক আন্দোলন– এই দুইয়ের মিলনবিন্দু সুভাষচন্দ্র বসু। বিপ্লবীদের উপর পুলিশী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে ছুটে গিয়েছেন মেদিনীপুর, চট্টগ্ৰামে। তরুণদের ডাক দিয়েছেন ভারত মাতার সেবায় এগিয়ে আসতে।

নিজের রাজনৈতিক গুরু ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের দেখানো পথেই বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি কংগ্ৰেসের মনোভাব পরিবর্তন করতে উদ্যোগী ছিলেন নেতাজী। কিন্তু অনশনে যতীন দাশের মৃত্যুবরণকে কংগ্ৰেসের প্রস্তাবে মর্যাদা দান হোক আর ভগৎ সিং এর ফাঁসি রদ করতে গান্ধীজির ভূমিকা — সবেতেই নিরাশ হতে হয় ‘দেশনায়ক’কে। তবুও আশা ছাড়েননি। গান্ধীজির সঙ্গে প্রবল মতপার্থক্য হলেও নিজের জনপ্রিয়তাকে আশ্রয় করে পরপর দুবার নির্বাচিত হন জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে কিন্তু সভাপতি যেই হোক না কেনো কংগ্রেস চলবে গান্ধীজির কথায়। কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে চেয়েছিলেন ইউরোপের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাইরের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজকে চরম আঘাত দিতে। কিন্তু পরাধীন ভারতবাসী ইংরেজদের হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অস্ত্র ধরবে কিন্তু দেশ স্বাধীন করতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নয়— এই ছিল গান্ধীজির অহিংসা তত্ত্ব। বিশ্বকবির একের পর এক চিঠিও ‘মহাত্মা’র মনে সুভাষের জন্য জায়গা তৈরি করতে পারে নি, সুভাষ তখন তার কাছে ‘Spoilt Child’ । কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হয়ে গঠন করেছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লক। কংগ্রেসের ভেতরে থাকা সুভাষকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও একা সুভাষ আরো ভয়ঙ্কর। তাই ইংরেজ যেসময় মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে সুভাষচন্দ্র বসুকে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই সময় নেতাজী ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের প্রাকৃতিক বাধা অতিক্রম করে পেশোয়ার , কাবুল, মস্কো হয়ে বার্লিনে। জার্মানি সেইসময় ইংরেজের চরম শত্রু। শত্রুর শত্রু বন্ধু।

তাই জাপান , জার্মানি, ইতালির সঙ্গে নেতাজীর বন্ধুত্ব। কিন্তু বন্ধুত্ব নিজের মতাদর্শকে, আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে নয়। তাই হিটলার, মুসোলিনিকে স্পষ্টভাষায় জানাতে পেরেছিলেন যে ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের শুধু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যই ব্যবহার করা যাবে অর্থাৎ শুধু ইংরেজদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ভারতবর্ষে ততদিনে এমন মতাদর্শের প্রবেশ ঘটেছে যার সমর্থকদের আনুগত্য এমন একটি মতের প্রতি যার ফলে তারা নিজের দেশের হীতের বিরোধী হতেও দ্বিধা করে না।যতদিন ইংলান্ডের সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার কোনো কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না আর জার্মানি ও সোভিয়েত রাশিয়া পরস্পরের বন্ধু ছিল, ততদিন ভারতের কমিউনিস্টদের কাছে ইংরেজ শত্রু ছিল। জার্মানি, সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করার পর ইংল্যান্ড ও সোভিয়েত রাশিয়ার সম্পর্ক তৈরি হয় আর ইংরেজ হয়ে যায় কমিউনিস্টদের বন্ধু।বর্তমানেও চীনের প্রতি কমিউনিস্টদের মনোভাব আমাদের অজানা নয়। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘Peoples War’ ম্যাগাজিন নেতাজীকে ‘তোজোর কুকুর’ বলতেও দ্বিধা করে নি।

নেতাজী দেশের স্বাধীনতার জন্য বিদেশের সাহায্য চেয়েছিলেন কিন্তু ফ্যাসিজম বা কমিউনিজমকে কখনো সমর্থন করেন নি। কমিউনিজম আর ফ্যাসিজম এর মিলগুলো তিনি তুলে ধরেছেন ‘The indian Struggle’ বইতে। তাঁর মতে কমিউনিজম আর ফ্যাসিজম উভয়েরই ব্যক্তির অধিকারকে খর্ব করে, সংসদীয় গণতন্ত্রকে নিন্দা করে , উভয়েই দলীয় একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং মতের বিরোধীদের দমন করে। ভারতবর্ষে কমিউনিজম যে মানুষের দ্বারা একদিন প্রত্যাখ্যাত হবে তার ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন নেতাজী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।রাষ্ট্রবাদের বিপক্ষে অবস্থানকেই কমিউনিজম এর বিফলতার প্রধান কারণ হিসেবে বলেছিলেন নেতাজী। সোভিয়েত রাশিয়াতে চার্চের বিরোধী হিসেবে কমিউনিজম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও ভারতের ক্ষেত্রে ধর্মবিরোধী মনোভাব সেইভাবে নেই।আর কমিউনিজমের অর্থনৈতিক তত্ত্বের কিছুটা ভারতবর্ষে গৃহীত হলেও , ভারতে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের বিশ্লেষণ কোনোভাবেই গ্ৰহণযোগ্য হবে না বলে মনে করতেন নেতাজী। তাই সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের প্রায় অর্ধশতাব্দী আগেই নেতাজী বলেছিলেন, ভারতবর্ষ কোনোভাবেই সোভিয়েত রাশিয়ার নতুন সংস্করণ হবে না। নেতাজীর পরিকল্পনা ছিল শুধু স্বদেশকে নিয়ে।১৯২৭ সালে দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে এক চিঠিতে লিখেছেন ‘যদি আমার বলশেভিক এজেন্ট হইবার ইচ্ছা থাকিত , তবে আমি সরকার বলিবামাত্র প্রথম জাহাজেই ইউরোপ যাত্রা করিতাম।তথায় স্বাস্থ্য পুনঃপ্রাপ্তির পর বলশেভিক দলে মিশিয়া সমগ্ৰ জগতে এক বিরাট বিদ্রোহ ঘোষণা করিবার উদ্দেশ্যে

প্যারিস হইতে লেলিনগ্ৰাড পর্যন্ত ছুটাছুটি করিতাম ; কিন্তু আমার সেরূপ কোনো ইচ্ছা বা আকাঙ্খা নাই’।

স্বদেশমুক্তিকে পেছনে রেখে কোনো আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন না সুভাষচন্দ্র বসু।

কমিউনিজম সংস্কৃতিকে অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি কৃত্রিম কাঠামো মনে করে আর ভারতবর্ষের সভ্যতার ঐক্যসূত্র সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ।

 

নেতাজী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন কিন্তু সেই সমাজতন্ত্র ভারতবর্ষের একান্ত নিজস্ব তা বিবেকানন্দের দেখানো পথেই পুষ্টিলাভ করবে। স্বামীজীর বাণী উদ্ধৃত করে ১৯২৯ সালের মার্চে এক বক্তৃতায় বলেন ‘এই তো বাংলার Socialism।এই Socialism এর জন্ম কার্ল মার্কসের পুঁথিতে নয়।এই Socialism’ এর জন্ম ভারতের শিক্ষাদীক্ষা ও অনুভূতি হইতে’। ঐ একই বক্তৃতায় নেতাজীর সাবধান বাণী ‘বলশেভিক রুশজাতির চিন্তাধারা যেরূপ দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হইতেছে তাহাতে আমার মনে হয় যে জ্ঞানালোকের জন্য রাশিয়ার উপর অতিনির্ভরশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় নহে’।

কখনো দুরারোগ্য রোগের আক্রমণ, কখনো নির্বাসন, কখনো পিতৃবিয়োগ , কখনো স্বাধীনতা আন্দোলনে সহকর্মীদের ঈর্ষা কোনো কিছুই টলাতে পারেনি সুভাষচন্দ্রকে। প্রয়োজন সুভাষের ভেতরের সেই মানসিক শক্তির উৎসকে চেনা , সেই শক্তি সঞ্চয়ের অনুশীলনকে বোঝা।মান্দালয় জেলে কারারুদ্ধ অবস্থায় সুভাষচন্দ্রের উপলব্ধি “ভয় জয় করার উপায় শক্তিসাধনা।দুর্গা , কালী প্রভৃতি মূর্তি শক্তির রূপবিশেষ।শক্তির যে কোন রূপ মনে মনে কল্পনা করিয়া তাঁহার নিকট শক্তি প্রার্থনা করিলে এবং তাঁহার চরণে মনের দুর্বলতা ও মলিনতা বলিস্বরূপ প্রদান করিলে মানুষ শক্তিলাভ করতে পারে। আমাদের মধ্যে অনন্তশক্তি নিহিত হইয়াছে,সেই শক্তির বোধন করিতে হইবে।পূজার উদ্দেশ্য—মনের মধ্যে শক্তির বোধন করা”। এই শক্তিসাধনার কথাই তো বলেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’-এ আর অরবিন্দ ‘ভবানী মন্দির’-এ।মান্দালয় জেলে দুর্গা পূজার জন্য অনশন আর আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে সরস্বতী পূজার অধিকার আদায় করে নেতাজী দেশবাসীকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও শক্তির আরাধনায় অবিচল থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উত্তুঙ্গ সমুদ্রস্রোতের মাঝে জার্মানির ডুবোজাহাজ থেকে জাপানি ডুবোজাহাজে একজন অসামরিক ব্যক্তির স্থানান্তরের উদাহরণ এক বিরল ঘটনা — নেতাজীর এই অদম্য সাহস ও ত্যাগ তাঁর প্রতিটি বক্তব্যে ফুটে উঠতো।জাপানে প্রতিক্ষারত রাসবিহারী বসু জানতেন, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান , কষ্টসহিষ্ণু এইরকম নেতাই পারেন বিদেশের মাটিতে যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে সেনাবাহিনী গড়তে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের এই অতিমানবীয় ঘটনাগুলি কবিগুরুর এই পঙক্তিগুলি দিয়ে ব্যক্ত করা যেতে পারে —-

‘যে শুনেছে কানে

তাহার আহ্বান গীত , ছুটেছে সে নির্ভীক পরাণে

সঙ্কট আবর্ত মাঝে , দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন

নির্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি ; মৃত্যুর গর্জন

শুনেছে সে সঙ্গীতের মত।’

নেতাজী প্রথমবারের জন্য জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর যে Planning Commission তৈরি করেছিলেন তা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে ‘নীতি আয়োগ’ রূপে বর্তমান যা ভবিষ্যৎ ভারত গঠনে নেতাজীর দূরদর্শীতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।নেতাজী বিশ্বসভ্যতায় ভারতবর্ষের যে ‘mission’ সফল করতে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন তার বাস্তবায়নের প্রাথমিক শর্ত নেতাজীর ‘ভারতবোধ’ ও আদর্শের উপলব্ধি।

 

তথ্যসূত্র:

১)The Indian Struggle — Subhash Chandra Bose

২) ভারত পথিক— সুভাষচন্দ্র বসু

৩) তরুণের স্বপ্ন– সুভাষচন্দ্র বসু

৪) তরুণের আহ্বান — সুভাষচন্দ্র বসু

৫) আমি সুভাষ বলছি— শৈলেশ দে

লেখক: পিন্টু সান্যাল